আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ডের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি : ক্রিকেটের লাভ-ক্ষতি
অঘোর ম-ল
ক্রিকেট বিশ্বায়নের জন্যই আজকে আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি। তবে আফগানিস্তানকে টেস্ট মর্যাদা দেওয়া হতে পারে এ বিষয়টি অনেক আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডও আলোচনায় ছিল। তাদের টেস্ট মর্যাদা দেওয়ার বা আলোচনায় থাকার দুটো কারণ ছিল। ক্রিকেট বিশ্বায়নের কথা বললে, এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। অন্যদিকে শুধুমাত্র ১০টি দল কেন টেস্ট খেলবে? সেখানে যদি ১২টি দল টেস্ট খেললে খারাপ কী?
তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আফগানিস্তান টেস্ট খেলার জন্য অবকাঠামোগতভাবে কতটুকু প্রস্তুত? এ প্রশ্নটি ক্রিকেট বিশ্লেষকদের থাকতে পারে। এ কারণে থাকবে যে আফগানিস্তান এখনো একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ। যেখানে তাদেরকে দেশ পুনর্গঠনে দিকে সময় দিতে হচ্ছে বা কাজ করছে সেখানে এ অবস্থায় আফগানিস্তান টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য কতটুকু প্রস্তুত। আফগানিস্তান নিজস্ব ভেন্যুতে এখনো ক্রিকেট খেলতে পারছে না। তাদেরকে বাইরে বাইরে ক্রিকেট খেলে বেড়াতে হচ্ছে।
আয়ারল্যান্ডের অবকাঠামোও ঠিক আছে এবং ক্রিকেট ইতিহাসও তাদের খারাপ না। তবে প্রশ্ন হচ্ছেÑ কতজন খেলোয়াড় আছে টেস্ট খেলতে পারবে বা তাদের টেস্ট খেলোয়াড়ের সংখ্যা কত? তারা তো দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট খেলে অভ্যস্তও নয়। ঠিক এ বিষয়টি আরও একটু ভেবে দেখা দরকার ছিল। বরং তাদেরকে বলা যেতে পারত, আপনারা এই এই শর্তগুলো পূরণ করেন, তারপর দুই বছর পর আপনাদের টেস্ট মর্যাদা দেওয়া হবে বা টেস্ট খেলতে পারবেন।
মনে হচ্ছে, আইসিসির এলিটদের ভেতরে আরেকটি এলিট তৈরি করার প্রক্রিয়া। নতুন টেস্ট মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। টেস্ট র্যাংকিং টপ নাইন খেলবে একসঙ্গে আর বাকি তিনটি দল জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড খেলবে আলাদা। আমার মনে হয় টোটাল সিস্টেমের ভেতরের দিকে গেছে আইসিসি। অর্থাৎ এলিট শ্রেণির ভেতরে আরেকটা এলিট শ্রেণি তৈরি করা। আবার দেখা যেতে পারে নয়টি না করে, আটটি দল করল বা সাতটি করল। সেটা যেন আবার না হয়। আমাদের শঙ্কার জায়গাটা ওখানে। যাতে করে ক্রিকেট মাঠে আবার শুধুমাত্র বিগ থ্রির অন্য কোনো ফর্মূলা আবিষ্কৃত না হয়। যাতে করে আমরা-আমরা বেশি খেলা খেলি সে ফর্মূলায় না যেন যায়।
সর্বোপরি নতুন দুটো দেশ টেস্ট মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি ঠিক আছে। আইসিসির অর্ধ পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পরিবর্তন করা। নতুন নতুন কিছু আইডিয়া বাস্তবায়নের করতে যাচ্ছে আইসিসি। তবে এখানে একটি বিষয় ব্যালেন্স করা হলো। ইউরোপ এবং এশিয়ার ক্রিকেট শক্তিটাকে যেমন বিস্তৃত করা হলো আফগানিস্তানকে টেস্ট পরিবারে নিয়ে আসায়। পাশাপাশি ব্যালেন্স হিসেবে আয়ারল্যান্ডকেও রাখা হলো। এশিয়ার পাঁচটি দেশই টেস্ট খেলবে এটা ক্রিকেটের অগ্রযাত্রারই প্রতিফলন। এটা হচ্ছে ক্রিকেটে এশিয়ার এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ।
যে ক্রিকেটটা ইউরোপ বা ইংরেজদের হাত ধরে যাত্রা শুরু, পরবর্তীতে এশিয়া ছাড়াও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া। ক্রিকেট খেলাটাকে অন্যরা ধারণ করেছে আর এশিয়ার মানুষ শুধু ধারণই করেনি, ভালবেসে লালন করে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে বা রাখছে। সে কারণেই আফগানিস্তান নতুন দেশ হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে আসল। তা অভিনন্দন পাওয়ার মতো।
তবে আমার যেটা মনে হয়, আফগানিস্তান আজকে এখানে আসার পেছনে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের বড় একটি অবদান ছিল। তারা আফগানিস্তানকে নার্সিং এবং খেলোয়াড়দের তৈরি করেছে। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল যারা বিলুপ্ত করেছে আজ তারা আবার নতুন করে ভাবতে পারে এই কাউন্সিল থাকলে কী লাভ হয়। আইসিসির তত্ত্বাবধানে রাইজিং কান্ট্রি হিসেবে নেপাল উঠে আসতে পারবে কিনা সেটা দেখার বিষয়। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল থাকলে এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ টেস্ট খেলে ক্রিকেটে আরও দাপট দেখাতে পারত। সে জায়গাটা আবার নতুন করে ভাবা উচিত। যারা এশিয়ান ক্রিকেটের দায়িত্বে আছেন বা এশিয়ান ক্রিকেটের হর্তাকর্তা আজ সম্ভবত আফগানিস্তান প্রমাণ করে দিল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রয়োজনীয়তা। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল থাকলে মনে হয় এশিয়ার ক্রিকেটের জন্য ভালো হতো। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডের অবকাঠামোগত উন্নত। তারা ক্রিকেটে হঠাৎ করে আসেনি। আইরিশদের অনেক খেলোয়াড় আছে যারা ইংল্যান্ডের জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলে। আবার বেশকিছু খেলোয়াড় ইংলিশ কাউন্টি খেলে থাকে, তারা ভাবতে পারে নিজেদের মাঠ থাকতে কেন বাইরে এত দূরে টেস্ট খেলতে যাবে। আয়ারল্যান্ডের অবকাঠামো আছে এমনকি তাদের খেলোয়াড়ও আছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটে টিকে থাকার ব্যাপার। অবকাঠামো ছিল এবং খেলোয়াড় ছিল তারপরও জিম্বাবুয়ে কিন্তু হারিয়ে গেল বা হারিয়ে যাচ্ছে। খেলার দৌড়ে এগিয়ে থাকা বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা দল কেনিয়া একসময় বাংলাদেশের চেয়েও অনেক ভালো ছিল। সে দলটি এখন কোথায় হারিয়ে গেল।
এই জায়গাগুলো থেকে আমরা নতুন দেশকে স্বাগত জানাচ্ছি কিন্তু তাদের ক্রিকেটটাকে আরও উন্নত করার জন্য সার্বিকভাবে পরিকাঠামো তৈরি করে দেওয়ার পাশাপাশি খেলার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আর তা না হলে কিন্তু জিম্বাবুয়ের মতো আরেকটি দল টেস্ট পরিবারে দেখতে চাইব না। কেনিয়ার মতো অন্য দেশগুলো যেন হারিয়ে না যায় সে বিষয়টি ভাবতে হবে বা ভাবার সময় এসেছে।
সারা দুনিয়ায় যেখানে ফুটবল, টেনিস এবং রাগবির মতো জনপ্রিয় দলের দাপট, সেখানে খেলার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ৫-১০টি দল নিয়ে এগোলে হবে না, ক্রিকেট কর্তারা সেটা বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে। যে কারণে বিশ্বায়ন না হলে ক্রিকেটের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটা কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে ফুটবল ঢুকছে। ভারত অনূর্ধ্ব ১৭ ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করছে। ফুটবলে স্পন্সরদের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। যদি সঠিকভাবে নার্সিং না হয় তাহলে ফুটবলের উন্মাদনায় এশিয়া থেকে ক্রিকেট হারিয়ে যেতে বেশিদিন লাগবে না। ক্রিকেটের স্বার্থেই বিশ্বায়নটা খুব জরুরি। বিশ্বায়ন ছাড়া ক্রিকেটের আর্থিক বুনিয়াদ শক্ত হতে পারে না। যত বেশি দল থাকবে তত বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করা যাবে।
পরিচিতি: ক্রীড়া বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ: বায়েজিদ হোসাইন
সম্পাদনা: আশিক রহমান