কতজন বাংলাদেশি আইএসএসে যোগ দিয়েছে?
কামরুল আহসান : স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে বাংলাদেশের বেশকিছু তরুণ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ যোগ দিয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের কেউ কেউ সরাসরি সিরিয়া চলে গেছে। আবার কেউ কেউ পড়াশোনা বা কাজের ছুতোয় মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আছে। তাদের কেউ কেউ সিরিয়ার যুদ্ধে মারা গেছে বলেও জানা গেছে।
ঠিক কতজন বাংলাদেশি আইএসে যোগ দিয়েছে তার সঠিক তথ্য অবশ্য জানা যায়নি। ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের সংখ্যা ২০ জনের বেশি হবে না। কিন্তু, ট্রিবিউনের প্রতিবেদকের মতে, তাদের সংখ্যা হবে ৫০-এর উপর। আরও ৫০ জন প্রবাসী বাংলাদেশিও আইএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
কাউন্টার টেররিজম পুলিশ প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আইএসে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ২০ বাংলাদেশির নাম তাদের কাছে আছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘আমরা তথ্য পেয়েছি যে তাদের বেশির ভাগই মারা গেছে। তাদের অনেকে ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্তেই ধরা পড়েছে। কারণ তাদের নাম সীমান্ত পুলিশের কাছে সংরক্ষিত ছিল। তারা কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সীমান্ত পুলিশ তাদের সম্পর্কে খুবই সচেতন।’
মনিরুল ইসলাম আরও জানিয়েছেন যে, বাইরে থেকে এখন আর খুব সহজে আইএসে যোগ দেওয়া যায় না। তেমনি একবার ঢুকতে পারলে আর বের হওয়া যায় না। আইএস জঙ্গিরা কাউকে আর বের হতে দেয় না। আইএস গোষ্ঠী ত্যাগ করে কেউ বাইরে এসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাবে এরকম ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মাত্র একজন লোকই সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েও আবার বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। কারণ, সেখানে গিয়ে তাদের মতাদর্শের সঙ্গে তার মিলেনি। সে এখন কারাগারে বন্দি আছে।
২০১৪ সালের পর অনেক সংগঠন আইএসে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কার্যক্রম চালিয়েছে। তাদের মধ্যে একটি দলের নাম ‘এক্স-ক্যাডেট ইসলামিক লার্নিং ফোরাম’। তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে আইএসের জন্য তরুণদের সংগ্রহে। ফেসবুক নির্ভর এই দলটির প্রধান ছিলেন সুজিত দেবনাথ, জাপান পড়তে গিয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তারপর নিজের নাম রাখেন সাইফুল্লা ওজাকি। তার মাধ্যমেই ২০-২৫ জন তরুণ আইএসে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আছে আমিনুল ইসলাম বেগ, নাজিবুল্লাহ আনসারি এবং আসাদুল্লাহ গালিব। অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রবাসী বাংলাদেশি এটিএম তাজউদ্দিনও তাদের সাথে যোগ দেয়। এই পুরো দলটিই আরও তরুণদের সংগ্রহ করেছে আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়ে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করার জন্য।
২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ কাজি সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়াকে গ্রেফতার করে। তিনি একটি গার্মেন্টসের মালিক। কোর্টে জবানবন্দি দেওয়ার সময় তিনি বলেন, ২০১৩ সালের মাঝামাঝি তিনি সাইফুল্লা ওজাকির সঙ্গে উত্তরা পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে দেখা করেছিলেন। সেখানে তার ছেলে পড়ে। ওজাকি পরে তাকে মুহিব নামে আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মুহিব পরে স্কলারশিপ নিয়ে জাপান চলে যায়। মুহিব ছিলেন সিলেটের একটি ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। জাপান গিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতে ওজাকি তাকে আইএস মতাদর্শে দীক্ষিত করে সিরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিল।
পুলিশ পরে জানতে পারে পিস স্কুল মৌলবাদী শিক্ষা প্রচার করে থাকে এবং ছাত্রদের পিস টিভির প্রতি আগ্রহ জন্মাতে দীক্ষা দেয়, যা ভারতের বিতর্কিত ধর্মীয় বক্তা জাকির নায়েকের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ২০১৬ সালে ওই স্কুলের দুটি শাখাই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ইয়াহিয়ার জবানবন্দি থেকে আরও জানা যায়, ওজাকি ২০১৪ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশে ফিরে আসে, তখন তিনি আরও এক তরুণের সঙ্গে ইয়াহিয়ার পরিচয় করিয়ে দেয়, সেই তরুণের নাম গাজি সোহান। গাজি সোহান সিরিয়ায় গিয়েছিল এবং আইএস-এর সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করে এসেছে। সে এখন কারাগারে বন্দি।
ইয়াহিয়া আরও জানায়, ওজাকি তার কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য খাবার কেনার জন্য। ওজাকি আরও অনেক বাংলাদেশির কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছে এবং অনেক মানুষ সিরিয়ায় পাঠিয়েছে আইএসএ যোগ দিয়ে যুদ্ধ করার জন্য।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জানিয়েছে, কোন বাংলাদেশি প্রথম আইএসে যোগ সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত না। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, তাদের মধ্যে সাইফুল হক সুজনের নামই বারবার উঠে এসেছে। তিনি যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে ছিলেন প্রায় ১০ বছর। ২০১৪ সালে তিনি যুক্তরাজ্য ছেড়ে আইএসে গিয়ে যোগ দেন। ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জানায়, সুজন রাক্কা শহরে বিমান হামলায় মারা গেছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী তাকে একজন কম্পিউটার হ্যাকার এবং আইএস এর একজন প্রধানতম ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। সাইফুলের স্ত্রী এবং তিন সন্তান এখনো সিরিয়ায় আছে বলেই তাদের বিশ্বাস।
একটি গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩৮ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশ থেকে সিরিয়ায় গিয়ে আইএস-এ যোগ দিয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন গেছে সিঙ্গাপুর থেকে, ৯ জন গেছে তুরস্ক থেকে, ৭ জন গেছে মালয়েশিয়া থেকে, ৪ জন গেছে আরব আমিরাত থেকে, ২ জন গেছে জাপান থেকে এবং কাতার, ইরান ও সোদি আরব থেকে গেছে ১ জন করে। ঢাকা ট্রিবিউন থেকে অনুবাদ