শিক্ষাব্যবস্থা বনাম দক্ষ মানবসম্পদ
ফাহমিদা হক
অর্থনীতির বিচারে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। যে দেশ ক্রমশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবার পথে চলমান। কিন্তু এই চলায় কতটা অগ্রগতি হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, মাপকাঠি যদি বেকারত্বের দিক থেকে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে সেই অগ্রসরের চিত্রটা যে সুখের নয়, তা সহজে অনুমান করা যায়। শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৫-১৬)-এর দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরও সামনে আসে। আমাদের দেশে এখন প্রায় ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। যারা বসে আছে, শ্রম দিতে প্রস্তুত, কিন্তু পারছে না। দুঃখের বিষয় হলো, এই বেকারদের অধিকাংশই উচ্চ শিক্ষিত। যেখানে উচ্চ শ্রেণি হতে ডিগ্রি নিয়ে বছরের পর বছর উপযুক্ত কাজের আশায় বেকার বসে থাকতে হচ্ছে অথচ এই একই জরিপ বলছে আরও মজার কথা, তা হলো একেবারে পড়ালেখা জানে না এমন ব্যক্তিরাই সবচেয়ে কম বেকার। তা হচ্ছে ২.২ শতাংশ, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ তরুণীরা বেকার ১০.১ শতাংশ। আর এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ ৩ লাখ ১৫ হাজার বেকার রয়েছে। তার মানেও এই না যে, আমাদের দেশে একেবারেই কর্ম সংস্থান নেই। কর্ম সংস্থান অবশ্যই আছে, কিন্তু যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ নেই। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় যেন বেকার তৈরির কারখানা। আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনেক আলোচনা করি। কিন্তু মূলকথা হলো বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না আর তা না হলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। আমাদের দেশে উচ্চ পর্যায়ের কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ বিদেশিদের দখলে। বিশেষ করে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কানদের দখলে, প্রতিবছর এর প্রভাব বাড়ছে। আর অর্থের একটা বড় অংশ এই খাত দিয়ে চলে যাচ্ছে বাইরে। অথচ দেশে প্রচুর শিক্ষিত বেকার রয়েছে তারপরেও কেন বিদেশিরা এ স্থান দখল করে আছে, এর আসল কারণ খুঁজে বের করতে গেলে একটাই কথা আসে তা হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন দিল্লির লাড্ডু, যে খাবে সে পস্তাবে, যে না খাবে সেও পস্তাবে! আমাদের দেশের একজন শিক্ষিত যুবক কর্মজীবনে প্রবেশ করলে, সেখানে তাকে আবার প্রথম থেকে শিক্ষা লাভ করতে হয়। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোনো কাজে আসে না। যার কারণে তাকে শিক্ষার্থী হয়ে থাকতে হয়। আর এখানে এসেই বিপদে পড়ে কর্মদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ। সেখানে তারা একজন তৈরি করা কর্মী খোঁজে। কোনো জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী নয়।
আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীকে কর্মী হিসেবে গড়ে দিতে পারে না বিধায়, এখনো এদেশে বিদেশ থেকে কর্মী আমদানি করতে হয়। ব্যাপারটা অবশ্যই কর্মদাতাকে বাধ্য হয়েই করতে হচ্ছে এটাও কারও বোঝার বাকি নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞানুযায়ী যারা সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কর্মে নিয়োজিত থাকবেন তারা আর বেকার নন। বাংলাদেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করতে পারেন না এমন বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ, এই সংবাদটি অবশ্যই আতঙ্কের। আর এই বেকারত্বের জন্য তরুণদের দায়ী করা যাবে না অবশ্যই, এই দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার, আমাদের সরকারের।
যে তরুণদের নিয়ে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ এর কথা বলা হয় সেই তরুণদের মাঝেই বেকারের হার সবচেয়ে বেশি ১০ দশমিক ৪ ভাগ লক্ষ্য করা গেছে। বেকারত্ব জীবনের বড় একটি অভিশাপ। বেকার তরুণরা প্রায়ই বিষণœতায় ভোগেন। এই অভিশাপ একজন তরুণকে সহজেই বিপদগামী করে ফেলতে পারে। তাই বেকারদের সহযোগিতা করে, বন্ধ করতে হবে বেকার তৈরির প্রক্রিয়া। শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতরা যেন বেকার না থাকে, বেকার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের না হয়, তৈরি করতে হবে সেই পথ। কর্মের অভিজ্ঞতা যেন একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই পায়, অবশ্যই প্রবর্তন করতে হবে সে রকম শিক্ষানীতি। তবেই শিক্ষিত তরুণরা অভিশাপ না হয়ে, রূপান্তরিত হবে মূল্যবান সম্পদে। বেকারত্বের দায় দেশের সরকারের, তাই সরকারকেই এই অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে। তৈরি করে দিতে হবে বেকারদের কর্মসংস্থানের। আর এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলে অবশ্যই বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের পথ ধরে হেঁটে সঠিক দরজায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন