জঙ্গিদের শিকড় উৎপাটনে অর্থের যোগান বন্ধ করতে হবে
মে. জে. এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
পুলিশের নিরলস প্রচেষ্টায় গত এক বছরে জঙ্গিরা কোনোরকম কোনো তৎপরতা চালাতে পারেনি। যদিও তারা বিভিন্ন সময়ে বহুভাবে চেষ্টা করেছে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। এমনকি চালিয়েছিল নানারকম তৎপরতা। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ সক্রিয়ভাবে তাদের অবস্থান এবং আস্তানাকে সনাক্ত করেছে। পুলিশ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে তাদেরকে দমন বা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।
জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে পুলিশ যে ভূমিকা রেখেছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সেখানে কোনরকম সন্দেহ নেই। আমরা দু’এক বছর আগেও দেখেছি দেশে গুপ্তহত্যা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে ধর্মযাজক থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু মানুষের ওপরেও হামলা হয়েছে। এই হামলা থেকে বিদেশি নাগরিকরাও বাদ যায়নি। ফলে সেখানে তাদের জীবন রক্ষা না করতে পারার কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা হয়েছে।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তাদের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলেই আজকের এই সফলতা দেখাতে পেরেছে। এতকিছুর পরেও কিন্তু জঙ্গিদের শিকড় উৎপাটন হচ্ছে না। জঙ্গিদের শিকড় উৎপাটন করা কিন্তু পুলিশের দায়িত্ব নয়। সেটা রাজনৈতিক সমস্যা। বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরে এই শিকড় নিহিত। এই শিকড় উৎপাটনের জন্য রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে আন্দোলন হওয়া দরকার। এর মাধ্যমেই শিকড় উৎপাটন করা সম্ভব। সেখানে আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে। এখনও মনে করি, জঙ্গিবাদের হুমকি থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের আশঙ্কা রয়েছে আগামীতে তারা এ ধরনের প্রচেষ্টা আরও চালাতে পারে। কারণ তাদের এই শিকড় অটুট থাকার কারণে তাদের বংশবৃদ্ধি হবে অর্থাৎ জঙ্গিবাদ বৃদ্ধি পাবে। জঙ্গিদের অর্থ যোগানদাতার চ্যানেলটি বন্ধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে এই অর্থ দেশের ভেতর এবং বাইরের দেশ থেকে আসে । যার জন্য অর্থের যোগানটা অব্যাহত রয়েছে।
এই তৎপরতা চালানোর একটা সম্বল তাদের সবসময় হাতে থাকছে। এখানে বহুমুখি স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি এপ্রোচ দরকার। সেখানে দুর্বলতা আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত একবছরে যা তা ধরে রাখার ব্যাপারে পুলিশের অঙ্গীকার বজায় রাখা দরকার। সুতরাং এখানে পুলিশের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাদের এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বহুরকম বাঁধা বিপত্তি শেষ করেই সামনে এগোতে হবে।
অন্যদিকে জঙ্গিবাদ সমূলে উৎপাটনের আশঙ্কা থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারেনি। তার কারণ হলো, তাদের শিকড় ও অর্থনৈতিক চ্যানেল অটুট রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পাকিস্তান সরাসরি জঙ্গিবাদের তৎপরতায় জড়িত। ইতিমধ্যে হাতেনাতে ধরা পড়ে অনেকেই কারাবরণ করেছে। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কারণে তাদের কূটনীতিকরা এদেশ থেকে বহিষ্কার হয়েছে। জঙ্গিদের বিষয়ে তাদের অবস্থান এবং বক্তব্যের কারণে সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিশ্বাঙ্গনে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তির সংশ্লিষ্টতায় হয়তো জঙ্গি কার্যক্রম কিছুটা কমবে। তবে তাদের মূল যে মতবাদ, ধর্মান্ধতা বা উগ্রবাদিতার প্রচার-প্রচারণা এবং তাদের অর্থের সংস্থান থাকার কারণে এটি আরও বেশি অব্যাহত থাকবে। এটি একটি হুমকি হিসেবে থেকে যাবে।
সুতরাং এই অব্যাহত হুমকি মোকাবিলার জন্য আমাদের আগামীতে বহুমুখি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সেখানে স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি এবং মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মধ্যে রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক একটা দিক রয়েছে। এই বিষয়টি আরও বহুমুখী সংস্কৃতি অঙ্গন, মিডিয়ার অঙ্গন এবং যৌথভাবে বহুমুখি কর্মসূচি গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে এবং সেটি করা দরকার।
জনসাধারণ যদি সতর্ক হলে তাদের এই অর্থের যোগানদাতারা আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না। জনসচেতনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জণগণকে সচেতন করে তোলা উচিত। যাতে তারা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দল মত নির্বিশেষে সবাই যেন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সেই জায়গায় বহুমুখি করণীয় আছে। সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো হচ্ছে। পুলিশের সক্ষমতা আরও বাড়ানো দরকার। যেখানে কোনরকম শিথিলতা বা কোনো আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আমাদের বিচার প্রক্রিয়ায় শৈথিল্য এবং ভয়ানক দুর্বলতা দেখি, এতে শত শত জঙ্গি জামিন পাচ্ছে এবং চিহ্নিত জঙ্গিরা যারা সরাসরি ধরা পড়েছে তারাও জামিন পেয়ে যাচ্ছে। তারা জামিন পেয়ে আবার একই ধরনের কর্মকা-ে জড়াচ্ছে। এই জায়গাটা আরও জোরদার করা দরকার।
পরিচিতি : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ : ফাতেমা-তুজ-জোহরা