রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে টাকা পাচার বাড়ছে
জাফর আহমদ : সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকা বেড়েই চলেছে। ২০১৫ সালে সেখানে জমা টাকার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ১৯ শতাংশ বেড়ে সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত না করা এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের তদন্তে জিজ্ঞাসাবাদ না করার কারণে দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
প্রতি বছর এভাবে টাকা পাচারের ঘটনা খুবই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, টাকা পাচারের ঘটনাটি সামনে আসার পর অন্য দেশ ব্যবস্থা নিয়েছে। সুইস ব্যাংকে সেসব দেশের নাগরিকের জমা হওয়া টাকার পরিমাণ নিম্মগামী। বাংলাদেশ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে তা ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। শুধু সুইস ব্যাংকেই নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অবাধে টাকা পাচারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। মালয়েশিয়া এখন টাকা পাচারের একটি নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে গেছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। এসব টাকা দেশে বিনিয়োগ হওয়ার কথা। তা না হয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে বিদেশে। দেশে বিনিয়োগ হলে দেশের মানুষ যে সুবিধা পেত, দেশ যে সেবা পেত পাচার হওয়ার কারণে দেশ তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ‘নিচ্ছি, নেব’ করে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এজন্য প্রতি বছর বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্র্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, অতীতে টাকা পাচারের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার ব্যবস্থা নিলে নতুন করে আবারও টাকা সুইস ব্যাংকে বৃদ্ধি পেত না। প্রতিবেশী ভারতে এ ধরনের পাচারের অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়ার কারণে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা টাকার পরিমাণ কমে এসেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকেও এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের অভিযোগ ওঠার পর কারো বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
বাংলাদেশের দুর্নীতি ও বিনিয়োগে সহজ পন্থা না হওয়ার কারণে দেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দেশ থেকে টাকা শুধু অবৈধভাবেই পাচার হচ্ছে না, বৈধ টাকাও দেশ থেকে বাইরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে কিন্তু চোখে পড়ার মতো উন্নতি হচ্ছে না। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি টাকা বৃদ্ধির জন্য এটিও একটি কারণ।
টাকা পাচার রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, টাকা পাচারের মূলে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরের কিছু কারণ। বাইরের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন রকম চুক্তি ও কনভেনশন আছেÑ সেগুলো কাজে লাগিয়ে এসব টাকা পাচারে রোধ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এটর্নি জেনারেলের অফিস মিলেও টাকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রয়োজনে সুইস ব্যাংকের সঙ্গে প্রয়োজনে যোগাযোগ করে এসব পাচার রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও বিষয়টি সহজ হবে না।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার রোধে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি, পাচার রোধে দৃশ্যমান উদ্যোগ ও বিনিয়োগ আকর্ষণে ‘ওয়ানস্টপ’ কার্যক্রম শুরু জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ এগমন্ডের সদস্য। এগমন্ডের সহযোগিতা নিয়ে এ ধরনের পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী