পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের দায় কি বাঙালি বসতিদের?
মিল্টন বিশ্বাস
প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। এদেশে অতিবর্ষণে প্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তবে গত ১১-১৩ জুন ২০১৭-তে ভারি বর্ষণের সময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজারে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। ওই ঘটনায় ৫ জন সেনা কর্মকর্তাও মারা গেছেন। যারা সাহসের সঙ্গে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে অকালে ঝরে যান মাটিচাপা পড়ে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের করণে প্রাণহানির ঘটনা একবারে নতুন না হলেও এ বছরের পাহাড় ধসজনিত বিপর্যয় ইতোপূর্বেও সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের মধ্যে নিঃসন্দেহে রাঙামাটিতে এ বছর প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের এই বিষয়টি সামনে রেখে বর্তমানে বেসরকারি টেলিভিশনে টক-শো সমূহে বক্তাদের বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের অযাচিত মন্তব্য এবং বিভিন্ন প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকাগুলোর রিপোর্টগুলোতে আপাতদৃষ্টিতে সাম্প্রতিক পাহাড় ধসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে। গত ১৬ জুন ২০১৭ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় ‘ছয় বছরে নিহতদের ৬৪ ভাগ বাঙালি’ শিরোনামের একটি কলামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বন ও পাহাড় কেটে যত্রতত্র বাঙালি পুনর্বাসন করা হয়েছে। অধ্যাপক আখতার পার্বত্য অঞ্চলের এই বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে যথেষ্ট গবেষণা করে উপরোল্লেøখিত মন্তব্য করেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি একেবারে সরলীকরণ করে পক্ষপাতমূলকভাবে কোনো একটি জনগোষ্ঠীর উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ অবিবেচনাপ্রসূত। সাম্প্রতিক বছরগুলোর কথা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে দেখা যায় যে, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের ৭টি স্থানে পাহাড় ধসের কারণে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়, ২০০৮ সালের ১৮ চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে ৪ পরিবারের ১২ জনের মৃত্য হয়, ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকায় বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেওয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়, ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার ও সিলেটে ৯৪ জন মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ২০১৫ সালের ২৬-২৭ জুন টানা বর্ষণ, ধস আর পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ১৯ জনের মৃত্যুর বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পাহাড় ধসজনিত এই প্রাণহানির বিষয় বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় যে, পাহাড় ধসের ভৌগোলিক বিপর্যয় শুধুমাত্র পার্বত্য জেলাগুলোতে নয়, পাহাড় পরিবেষ্টিত বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্থানেই ঘটেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভৌগোলিক দিক দিয়ে কিছুটা ভিন্ন। এখানে সমতল ভূমির পাশাপাশি উঁচু-নিচু, ছোট-বড় অনেক পাহাড় বা টিলা রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সাধারণত মাটি এবং বালু মিশ্রিত, এ সকল পাহাড়ের মাটি এটেল মাটির মতো আঠালো নয়। এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো সাধারণত পৃথিবীর অন্যান্য কিছু কিছু অঞ্চলের পাহাড়গুলোর মতো পাথর পরিবেষ্টিত নয়। এই পাহাড়গুলোর মাটি কোনো নির্দিষ্ট শক্ত অবলম্বনের অনুপস্থিতিতে ভারি বর্ষণের ফলে সহজে ধসে পড়ে। এখানে সহায়ক অবলম্বন বলতে ব্যাপক বনায়নই গ্রহণযোগ্য সমাধান। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পড়েছে। অনেক বছর আগে সাধারণত পাহাড়ের গ্রাম অঞ্চলে ‘সনাতনী উপজাতী বন ও কৃষি সভ্যতার’ ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিক্ষা থেকে ডধঃবৎংযবফ গধহধমবসবহঃ ও পরিবেশ সংরক্ষণের কলাকৌশল অনুসরণ করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করত। এ বিষয় অনস্বীকার্য যে এ ধরনের লোকজ জ্ঞানকেই ১৯৯২ সালে প্রথম বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে ‘ঞৎধফরঃরড়হধষ ঝপরবহঃরভরপ কহড়ষিবফমব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। অনেক আগের সেই সময়গুলোতে এই সনাতনী ধারা অবলম্বন করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা পাহাড়ের মাটি না কেটে খুঁটির ওপর ‘টং ঘর’ তুলত। এছাড়া তাদের ধর্মীয় একটি সংস্কার ছিল সেই সময়গুলোতে। প্রয়াস বিশিষ্ট উপজাতি গবেষক ও লেখক অমরেন্দ্র লাল খীসার গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় অধিকাংশ গোত্রের উপজাতিরা ‘ধরিত্রীকে আঘাত করে মাটি কর্ষণ করাকে পাপ মনে করত’। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপজাতিদের জীবনে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা, বাসস্থান ও পোশাক পরিচ্ছেদে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকাতেও উপজাতি যুবক যুবতীদের জিন্স, টি-শার্টেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেখা যায়। এখানে আরও একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পার্বত্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। অনেক আগে দুর্গম পাহাড় এবং প্রত্যন্ত এলাকায় যখন কোনো রাস্তা-ঘাট ছিল না, পাহাড়িরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য পেত না। সাম্প্রতিক কয়েক দশকের ক্রম উন্নয়নের অন্যতম হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা-ঘাট তৈরি। বর্তমান সময়ে প্রত্যন্ত এলাকায় উপজাতিদের উৎপাদিত পণ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের ফলে শহর এলাকায় পরিবহন সহজেই সম্ভব হয়। (চলবে-১)
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান