বাজেট বাস্তবায়নে ১ জুলাই থেকেই উদ্যোগী হতে হবে
গত বৃহস্পতিবার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেট সংসদে পাস হয়েছে। ১ জুন অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত সংসদে উক্ত বাজেট উত্থাপনের পর ব্যবসায়ীসহ সকল মহলের আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ব্যক্তিগতভাবে জর্জরিত হন। ভ্যাট এবং আবগারি শুল্ককেন্দ্রিক সমালোচনা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, বাজেটের অন্যান্য দিক প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এমনকি সরকারি দলের বেশ কজন সংসদ সদস্যও অর্থমন্ত্রীকে একহাত নিতে ছাড়েননি, সংসদের বিরোধী দল, বাইরের বিরোধী দল তো আকাশ-বাতাস উত্তপ্ত করতেই থাকে। মিডিয়াগুলোও ইউরেকা ইউরেকা শুরু করে দেয়। অর্থনীতিবিদরা অবশ্য এ ধরনের সমালোচনার বিপদ নিয়ে সতর্ক করছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! গেল গেল সবই যেন গেল, ভ্যাট নিয়ে গেল, আবগারি শুল্ক নিয়ে গেল! সরকার দেখল, জনমত যেভাবে ভ্যাট ও আবগারি শুল্ককেন্দ্রিক হয়ে গেছেÑ তা থেকে বাঁচতেই হবে! শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হলো। ভ্যাট আইন দুবছর স্থগিত করা হলো, আবগারি শুল্ক ঢেলে সাজানো হলো। এখন সবই ঠা-া। তবে মিডিয়াগুলো সরকারের এই পেছনে ফেরাকে ভ্যাটের সঙ্গে ভোটের সংযোগ ঘটিয়ে জনমতকে সে দিকেই ধাবিত করার কৌশল বলে অভিহিত করেছে। সবকটি পত্রিকার শিরোনামেই ভ্যাট ও ভোটের কথা উল্লেখ রয়েছে।
ভ্যাট আদায়ের সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তে ২৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে সরকার বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে বলে বিশেষজ্ঞগণ বলছেন। বাজেট বাস্তবায়ন নিয়েও অনেকে নানা ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা বিবেচনা করে সরকার যদি ১ জুলাই থেকে তৎপর হতে থাকে তাহলে অতিরিক্ত ২৪ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। বাংলাদেশে করদানে সক্ষম ব্যক্তির পরিসংখ্যান যথাযথভাবে নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। বছরে আড়াই লাখ টাকার অধিক আয় করেন এমন সব ব্যক্তিই যদি করের আওতায় থাকার কথা তা হলে দেশে প্রকৃত করদাতার সংখ্যা বর্তমানে ১১-১২ লাখের চাইতে বেশ কয়েকগুণ হওয়ার ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন ১১-১২ লাখের বেশি মানুষকে করের আওতায় এখনো আনা গেল নাÑ সেই প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা আছে। সরকারের উচিত হবে নতুন নতুন করদাতার সন্ধান করা, তাদের প্রকৃত আয়ের তথ্য উৎস বের করা, এখন যেসব ব্যবসায়ী, স্থাপনার মালিক, বেসরকারি চাকরিজীবী (সরকারি চাকরিজীবীদের বিষয়টি সন্ধানকৃত), দেশে-বিদেশে চুকিয়ে ব্যবসা করছেনÑ তারা কত টাকা আয়কর দিচ্ছেন, এগুলো যাচাই করা, কর ও ভ্যাট ফাঁকির জায়গাগুলো বন্ধ করা, দুর্নীতিবাজ এনবিআর কর্মকর্তাদের পিছুলাগা, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, সৎ কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দেওয়া, অসৎ ব্যবসায়ী ও মালিকদের কাছ থেকে প্রকৃত রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া, প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সততাকে নানাভাবে প্রণোদনা প্রদান করা, তাদেরকে সেভাবে উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া গেলে বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে বিকাশমান রাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত ২৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ কোনো ব্যাপারই নয়।
বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের সবচাইতে দুর্বলতা হচ্ছে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনা। সেটিকে শক্ত হাতে ভাঙা যাচ্ছে না। সরকারকে প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়িয়ে এ সংকট মোকাবিলার উপায় উদ্ভাবন করতেই হবে। অর্থবছরের শুরুতেই সেই দৃঢ়তা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে, তা হলেই আগামী বছর অর্থমন্ত্রী সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দের নতুন বাজেট জনতাকে দিতে পারবেন। আমরা তেমন অবস্থাটি আগামী বছর দেখতে চাই।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়