হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণে ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা
মাসুদ আলম : গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার বর্ষপূর্তিতে নিহতদের ফুলে ফুলে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করলো দেশি-বিদেশিসহ সর্বস্তরের মানুষ। তারা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে এর প্রত্যয় নেওয়ার ঘোষণা দেন। গত বছর ১ জুলাই এ নির্মম হত্যাকা- ঘটায় জঙ্গিরা। গতকাল শনিবার সকাল থেকেই থমথমে ছিল গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়ক। সেই সড়কের ৫ নম্বর বাড়িটিতে সকাল থেকে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে একের পর এক আসেন নিহত বিদেশি রাষ্ট্রদূত, স্বজন হারানো পরিবার আর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতানেত্রীরা। তারা সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর এক মিনিট নীরবতাও পালন করেন। এ সময় তাদের অনেকে ছিলেন অশ্রুসজল। হত্যার স্থানটিতে এক বছর পর এসে স্তব্ধ হয়ে যান স্বজনরা। স্বজনদের সঙ্গে শ্রদ্ধা জানায় ছোট শিশুরাও। সকাল সাড়ে ১১টার মধ্যেই ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নির্ধারিত বেদী। ভোর থেকেই হলি আর্টিজানের আশপাশে ছিল পুলিশি কড়া নিরাপত্তা। শনিবার সকাল ৭টা ২২ মিনিটে কড়া পুলিশ পাহারায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জাপানি রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবি। শ্রদ্ধা শেষে ৭টা ২৮ মিনিটে বেরিয়ে যান তিনি। এ সময় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও গুলশান বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন।
এরপর নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ইতালির নিহত স্বজন ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি দল। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সময় অনেকেই কেঁদে উঠতে দেখা যায়। গত বছর হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় ১৭ জন বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ইতালিয়ান ৯, জাপানি ৭ ও একজন ভারতীয় নাগরিক।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে, তবে নির্মূল হয়নি। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ও পুলিশ যৌথভাবে জঙ্গি দমনে সফলতা পেয়েছে। প্যারিসের পুলিশ যেটা পারেনি বাংলাদেশের পুলিশ সেটা করে দেখিয়েছে। এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের নেতারা উপস্থিত ছিল। এর পর শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
এদিকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনা হৃদয়বিদারক। আমাদের আবহমান বাংলার যে সাম্প্রতিক বন্ধন, তাতে কালিমার তিলক দিয়েছে এই হামলা। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যখনই বলা হয় উগ্রবাদ নির্মূল করা হয়েছে, তখনই দেশের কোথাও না কোথাও উগ্রবাদের হিংসাত্মক থাবা পড়ছে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, শক্তি দিয়ে জঙ্গিবাদ হয়তো সাময়িকভাবে দমন করা যায় কিন্তু নির্মূল করা সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ দমন করতে হবে আদর্শ দিয়ে। এজন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে, জামায়াতকে নিষেধ করতে হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন করতে হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী, শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা নুজহাত আলিম, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী প্রমুখ।
হলি আর্টিজান হামলায় নিহত হয়েছেন ইশরাত আখন্দ। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন পরিবার, মামা ও বন্ধুরা। সবাই ছিলেন বাকরুদ্ধ, অশ্রুসজল। সবাই ছিলেন নীরব। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন ইশরাতের বন্ধু ফারহানা আনন্দময়ী। তিনি বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর দিন সকালে জানতে পারলাম, ইশরাত আর নেই। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম সবসময়। সে তো আর ফিরে আসবে না, তাই তার স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা আর দেখতে চায় না কেউ। তাই জঙ্গি নির্মূলের প্রত্যয় সবার।
এদিকে সকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জাকির হোসেন শাওনের মায়ের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে গুলশান। রেস্টুরেন্টের সামনের রাস্তায় শাওনের ছবি হাতে, কণ্ঠে বিলাপ নিয়ে শাওনের মা চিৎকার করে বলছিলেন, জাকির হোসেন শাওন আর ফিরবে না।
বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, পুলিশ জীবন দিয়ে হলি আর্টিজানের হামলা মোকাবিলা করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা তা মোকাবিলা করতে গিয়ে দুজন সিনিয়র অফিসারকে হারিয়েছি। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সফল অভিযানের প্রশংসা পাচ্ছে। এ সময় তার সঙ্গে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন।
এছাড়া জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক) দাতা সংস্থা জাইকাসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা হলি আর্টিজানের নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সকাল থেকেই হলি আর্টিজানে বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন সর্বস্তরের নারী-পুরুষ ও শিশুরা। সাধারণ পথচারীও এ সময় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সম্পাদনা : হুমায়ুন কবির খোকন