মামলাজট কমাতে প্রশাসনের ক্ষমতার উপর জোর দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট
জান্নাতুল ফেরদৌস পান্না : দেশের সর্বোচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতগুলোতে প্রায় ৩২ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। মামলা জটের কারণ হিসাবে বিচারক সংকট, সাক্ষী হাজির করতে না পারা, আদালত সংকটসহ আদালতগুলোতে প্রশাসনিক অদক্ষতাকে বেশি দায়ী করেছেন আইনজীবীরা। এদিক সুপ্রিম কোর্টের এক প্রতিবেদনে মামলা জট নিরসনে প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারিক সেবা করতে বিচারকদেরকে সময় মতো আদালতে আসতে হবে। রায় দিতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। আদালত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্যাবলিই হচ্ছে আদালত প্রশাসন। বিচারকদের দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মচারীদের দক্ষতাও বৃদ্ধি করতে হবে। আর এর জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, বিচার বিভাগের সেবা বৃদ্ধি করতে নানা বিষয় উঠে এসেছে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদনে। বিশেষ করে আদালতের স্টাফদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম। এতে করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে এবং মামলার জটও কমে আসবে।
জানা যায়, সারাদেশের আদালতগুলোতে অন্তত ৩২ লাখ মামলার বিচার চলছে। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪ লাখের বেশি। মামলার পাহাড় জমে আছে জেলা জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও। এ সংখ্যা ২৮ লক্ষাধিক। এ নিয়ে দেশে সর্বমোট বিচারাধীন মামলা দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখেরও বেশি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দায়িত্ব গ্রহণের পর মামলার জট তুলনামূলক কমতে শুরু করে। আদালতের বিচারপ্রার্থীদের সেবার মান বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। বিশেষ করে বিচারকদের বিভাগীয় কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতেও প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম চালু করেন। এতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিচার কার্যক্রমের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শুরু হয় বিচার বিভাগীয় জাতীয় সম্মেলন হয়। এরপর পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলন করার উদ্যোগ নেন প্রধান বিচারপতি। গতবছর ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের আয়োজন করে সুপ্রিম কোর্ট। প্রথম দিনে সবার জন্য উম্মুক্ত থাকলেও দ্বিতীয় দিবসে শুধুমাত্র বিচারকরা অংশ নেন। এতে প্রধান বিচারপতি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকের জবাব চান। আদালতের মামলা জট কমাতে এবং বিচার বিভাগের সেবা বৃদ্ধি করতে তাদের পরামর্শও নেন। বিচারকরা বলেন, আদালত প্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এবং আধুনিক আদালত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ডিজিটালাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য একটি ন্যাশনাল জুডিশিয়াল ডাটাবেস সিস্টেম এবং জেলা ওয়ারি ডাটাবেস সিস্টেম প্রয়োজন। যাতে আদালতের কজলিস্ট, রায়সহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য থাকবে এবং বিচারপ্রার্থীরা সহজেই সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। আর বিচার বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট ওয়েব সাইট চালু হলে বিচারপ্রার্থীরা আদালতে তাদের আরজি, জবাব, আবেদন, অভিযোগসমূহ সহজেই পেশ করতে পারবেন। তবে এজন্য বিদ্যমান আইনে সংশোধন আনতে হবে বলে জানান বিচারকরা।
বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, আদালতের জন্য বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীর নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে। একইসঙ্গে দ্রুত পূরণ করতে হবে শূন্য পদসমূহ। এক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, যথাযথ ও হস্তক্ষেপমুক্ত হতে হবে। বার্ষিক পরিদর্শন ও বিচারিক সম্মেলন সঠিক সময়ে সম্পন্ন হলে পরবর্তী বার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সহজ হবে। আদালতের ডায়েরি, কজলিস্ট ও রেজিস্টারসমূহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া সকল আদালতে পর্যাপ্ত কম্পিউটার ও আইটি সরঞ্জাম সরবরাহসহ একজন করে আইটি কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেন বলেন, বিচারককে অবশ্যই নেতৃত্বের গুণাবলি মেইনটেইন ও প্রেজেন্ট করতে হবে। মামলা দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তির পরিমাণ বেশি হতে হবে। এজলাস সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। সিভিল আপিল শুনতে হবে বেলা আড়াইটার পর। বেইলবন্ড বিষয়ে মনিটর করতে হবে। ক্রিমিনাল আপিল মামলায় জামিন না দিয়ে একমাসের মধ্যে রায় দিতে হবে।
বিচারপতি এ, এম, এন বসির উল্লাহ বলেন, প্রত্যেক জেলা জজ ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে পুরাতন মামলার তালিকা তৈরি করে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে হবে। বিচারকদেরকে সময়মতো আদালতে আসতে হবে। রায় দিতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। আর রায়ের তারিখ পরিবর্তন করা উচিত না। তিনি আদালতকে প্রশাসনের দক্ষতার উপর নির্ভর করে জেলা জজ ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দিক নির্দেশনা এবং দক্ষতার উপর। তাই তাদেরকে দক্ষ হতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শ ম রেজাউল করীম বলেন, মামলা জট কমাতে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদনে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তিনি বলেন, মামলা জট কমাতে বিচারক সংকট, সাক্ষী হাজির করতে না পারা, আদালত সংকটসহ আদালতগুলোতে প্রশাসনিক অদক্ষতাই এর প্রধান কারণ। এই সমস্যাগুলোকে চিহিৃত করে তার দূরীকরণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ