টেলিভিশন মানুষকে কতটা বদলাতে পারে?
স্বকৃত নোমান
সারাবছর টিভি দেখা হয়ে ওঠে না। লম্বা ছুটির সময় এক-আধটু দেখা হয়। ১ জুলাই শনিবার দেখলাম এটিএন বাংলায় একটি নাটকের অংশ বিশেষ। ফজলুর রহমান বাবু প্রধান চরিত্র। তিনি গায়েন। মেয়েকে নিয়ে গ্রামে গান-বাজনা করেন। ওই মেয়ের সঙ্গে এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলের প্রেম। চেয়ারম্যানের মেয়ে কানাডা থেকে আসে। ফোকলোর নিয়ে গবেষণা করে। দেখা হয় ফজলুর রহমান বাবুর সঙ্গে। সে বাবুর সাক্ষাৎকার নেয়। প্রেম হয় বাবুর ছেলের সঙ্গে। ওদিকে চেয়ারম্যান স্বার্থের কারণে গায়েন বাবুকে গান-বাজনা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। বাবু গান-বাজনা ছাড়তে পারেন না। বাবুকে মেরে হাত ভেঙে দেয়, ঘরে হামলা করে, এমনকি গ্রাম ছাড়া করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না। কারণ চেয়ারম্যানের ছেলে ও মেয়ে বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। প্রতিবাদ করে। হেরে যায় চেয়ারম্যান। বাবুর বাড়িতে এসে বাবুর কাছে ক্ষমা চায়। বলে যে, ‘আমাকে তুমি গান শেখাবা ভাই?’ বলে জড়িয়ে ধরে তাকে। নাটক শেষ।
খুবই গতানুগতিক কাহিনী। খুবই সিম্পল। কিন্তু এই ধরনের সিম্পল নাটকগুলোই দেশের বৃহত্তর সমাজে ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করে। দর্শকদের চোখ খুলে দেয়। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে। দেশের কোটি কোটি মানুষ ধর্মান্ধতার নিগড়ে আবদ্ধ। ধান্দাবাজ মোল্লা-মৌলবিরা ধর্মের নামে তাদেরকে আরও গভীর এবং গভীরতর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন তাদের কানে এই কথা ঢোকাচ্ছেÑ গান-বাজনা হারাম। এ কথা কেউ বলার নেইÑ গান যে মানুষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি। আমাদের এত এত কেতাবি শিল্প-সাহিত্য শেষ পর্যন্ত গণমানুষের কোনো কাজেই আসছে না।
গ্রামের সাধারণ মানুষ গ্যাটের উচ্চতা বোঝে না, রবীন্দ্রনাথের সুক্ষ্মতা বোঝে না, তলস্তয়-দস্তয়ভস্কির বিস্তৃতি বোঝে না। তাদেরকে মর্ডানিজম, পোস্ট মার্ডানিজ, কলোনিজম, পোস্ট কলোনিজম, প্রাচ্যতত্ত্ব, পাশ্চাত্যতত্ত্ব, কলাকৈবল্যবাদ, ডিকনস্ট্রাকশন বা ম্যাজিক রিয়েলিজম বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। এসব তাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে। শুনে তারা হাসবে। বলবে যে, ‘বেশি লেখাপড়া করে পোলার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।’ কিন্তু টেলিভিশনে প্রচারিত এই খ- খ- নাটকগুলো তাদের বুকে আঘাত করবে, ধাক্কা দেবে। তাদের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি করবে। হয়তো তারা দোকানে বসে চা খেতে খেতে টিভিতে নাটকটি দেখল, বাড়ি গিয়ে এই নাটকের কথা বউকে বলবে, ছেলেমেয়েকে বলবে। বালিশে মাথা রেখে নাটকটির কথা ভাববে। ভাবতে ভাবতে তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসতেও পারে। তারা হাজামজা যে বদ্ধ কুয়ায় বসবাস করে, এমনও হতে পারে, এই একটি মাত্র নাটক ওই কুয়ার বাঁধটি ধসিয়ে দেবে। দেওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।
সাধারণ মানুষ কিন্তু গল্প শুনতে চায়, গল্প দেখতে চায়। এই যে প্রতিদিন টেলিভিশনে এত এত টক-শো হয়, এগুলোর প্রতি তাদের বিশেষ কোনো আকর্ষণ নেই। আকর্ষণ তাদের গল্প শোনার প্রতি, গল্প ভিজুয়ালে দেখার প্রতি। এইসব নাটক দেখে তাদের অন্তর ভিজে যায়। কারণ তাদের অন্তরটা তো পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পলি দিয়ে গড়া। সামান্য বৃষ্টিতেই থিকথিকে হয়ে যায়। সুতরাং বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক এই ধরনের খ- খ- নাটকগুলো বেশি বেশি প্রচার হওয়া দরকার। এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। বাংলাদেশের টিভির প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বাড়বে। বিদেশি চ্যানেলের প্রতি তারা বিমুখ হবে। হবেই। টেলিভিশনের শক্তি অনেক। মানুষকে আমূল পাল্টে দিতে পারে শক্তিশালী এই প্রচার মাধ্যম।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
সম্পাদনা: আশিক রহমান