প্রকৃতি এবং প্রকৃতি বিরুদ্ধতার উল্লাস
জার্মানিতে সমকামী বিয়ের স্বীকৃতি মিলেছে, এতে আমাদের এখানে অনেকে উল্লসিত। তারা উল্লসিত হোক, ব্যক্তি স্বাধীনতা তাদের উল্লাসকে পারমিট করে। কিন্তু এখানেও বৈপরীত্য রয়েছে। যারা উল্লসিত তারা নিরীশ্বরবাদী। অর্থাৎ তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। তারা মানেন প্রকৃতিকে, প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতেই জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-ধ্বংস, এখানে কোনো ঈশ্বর নেই, এমনটাই বলেন। চলুন মেনে নিই আপাতত। যুক্তির স্বার্থেই বলি, ‘প্রকৃতি’ সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখতেই একই প্রজাতির দুটো আলাদা নমুনা সৃষ্টি করেছে কিংবা প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু নিজেরা প্রাকৃতিক হয়েও ক্ষেত্রবিশেষে কেন যে তারা প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ‘কার্য কারণ’ বেমালুম চেপে যান বুঝি না!
মনোবিজ্ঞান বলে, মানুষ মাত্রই নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষিত হয়। কেউ তা সামাল দিতে পারেন, কারও সম্ভব হয় না। সেই ‘না পারাকে’ জাস্টিফাই করতে কেন ঈশ্বর বেচারাকে ডেকে নিয়ে অস্বীকার করা, কেনই বা অজুহাতে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নেওয়া! দরকারে ‘প্রকৃতিকে’ও ল্যাং মারা! নিরীশ্বরবাদী প্রকৃতির এমন সন্তানেরা নিজ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিতে পরিকর। ওনারা মানবকল্যাণেও পরিকর্ম। কিন্তু যে স্বাধীনতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, যে কল্যাণ অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসে তার সাথে স্বাধীনতা আর কল্যাণের কথিত ‘ক্রিয়াকর্ম’ যায় কী? আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র সমকামকে স্বাস্থ্যপ্রদ বলে না, এর সামাজিক প্রচলনকেও নিরুৎসাহিত করে। অবশ্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে বা চলবেন এমন কোনো কথা নেই, থাকলে সিগারেট কোম্পানিগুলো উঠে যেত। যেহেতু যায়নি সেহেতু নিষিদ্ধ আনন্দে অংশগ্রহণ করা যাবে না এমন নিষেধাজ্ঞা কারও কাছে ব্যক্তি স্বাধীনতার খেলাপ বলে বিবেচিত হতেই পারে। তবে অপ্রচলিত, অস্বাস্থ্যকর কিছুর প্রচার প্রপাগা-াও তো বহুজনের স্বাধীনতার খেলাপ, নয় কী? জানি এ আলাপও অনেকের পছন্দ নয়। কিন্তু কী করার, ঈশ্বরবাদীই বলেন কিংবা নিরীশ্বরবাদী যদি লক্ষ্য হয় মানুষের কল্যাণ, সেক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর আনন্দের বিরোধিতা করার কী কোনো বিকল্প আছে? প্রকৃতিকে রক্ষা করতেই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ বন্ধে দভোকাল’ হবারও কী বিকল্প আছে?
প্রকৃতি বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে সুন্দরবন রক্ষায় আন্দোলন হয়, আবার প্রকৃতির দইয়ে’ করতে নিষিদ্ধ আনন্দ উদযাপনেও আন্দোলন হয়, সেল্যুকাস, কী বৈপরীত্য!
পুনশ্চ: ‘প্র্রথা’ কথাটার সাথে যদি ‘বিরুদ্ধ’ কোনোকিছু যুক্ত হয় তাহলে তা বড়ই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, উত্তেজক হয়ে ওঠে। যেমন কোনো লেখকের নামের আগে যদি বসে ‘প্রথাবিরুদ্ধ লেখক’, তাহলে তার পাঠক সংখ্যা এমনিতেই বেড়ে যায়। মনোবিজ্ঞান বলে, নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত, ‘প্রথাবিরুদ্ধ’তো অন্যার্থে নিষিদ্ধই। গানের আগে যদি বসে ‘প্রথাভাঙার গান’, তাহলে আর যায় কই এমনিতেই শ্রোতার সংখ্যা হুড়মুড় করে বেড়ে যায়। অনেকটা আইটেম গানের মতোন, আইটেম গানও তো প্রথার বিরুদ্ধে, নয় কী? অনেকেই ‘বিরুদ্ধ’ শব্দটির প্রতি মোহাবিষ্ট হন। কারও মোহ কাটে, কেউ মোহগ্রস্ত থেকেই সকল মোহ কাটিয়ে যান।
যাই হোক, প্রথা ভাঙার প্রথম শর্ত হলো প্রথাগুলো জানা। কোন কোন প্রথা ভাঙতে হবে সেটা সম্পর্কে সম্মক অবহিত হওয়া। মানবদেহে যেমন দুরকম কোলেস্টরল রয়েছে, একটা উপকারী, আরেকটা ক্ষতিকর। প্রথা ভাঙতে গেলেও সমাজদেহের সেই দুরকম ‘কোলেস্টরল’ নির্ণয় করতে হবে। তবেই না প্রথা ভাঙার চিন্তা। প্রথাই জানা হলো না, ভাঙা হবে কী? কোনটা শিব কোনটা বাঁদর তা তো বুঝতে হবে, না হলে শিবের জায়গায় গড়া হবে বাঁদর, বাঁদরামীতে হতে হবে অতিষ্ঠ।
যারা নিজেদের প্রগতিশীল, আধুনিক, শিক্ষিত এবং ধীমান ভাবেন, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানকে অস্বীকার করা অন্তত তাদের সাজে না। নিজেরা প্রাকৃতিক হলে প্রকৃতির রীতির বিরুদ্ধাচরণ করাও সাজে না। না কী সাজে, কী বলেন প্রকৃতপ্রেমিরা?
ফুটনোট: অনেকে বলেন, ব্রিটিশরা আমাদের ভূ-খ- ছেড়ে গেছে, কিন্তু ‘সাহেব’ আমাদের ছেড়ে যায়নি। আমাদের সামাজিক আচরণ, আমাদের স্বকীয়তা এ শুধু আমাদেরই। সুতরাং ‘জার্মান’দের আচরণ আমাদের সাথে মিলবে কিংবা আমরা তাদের সাথে সঙ্গত করব এটা ভাবাও তো এক ধর-ের কূপম-ুকতা। বিজ্ঞানের কথা বলে, অবৈজ্ঞানিক, অস্বীকৃত ও অস্বাস্থ্যকর প্রথার সাথে তাল মেলানোও তো বিজ্ঞানমনষ্কতা নয়।
ঈশ্বরবাদীরা বলেন, প্রকৃতিও ঈশ্বরের সৃষ্টির একটা অংশ। যারা ঈশ্বর মানেন না তারা বলেন, প্রকৃতিই মূলত প্রাকৃতিক, অন্যকিছু নয়। যেটাই হোক প্রকৃতি বিরুদ্ধ হওয়ার তো কোনো সুযোগ বা জায়গা নেই, উচিতও নয়। মূলকথা একটাই প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক রীতিকে রক্ষা করতে হবে এবং তা আমাদের স্বার্থেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান