সাহারার যাযাবর জনগোষ্ঠী তুয়ারেগদের বিচিত্র জীবন
মুজতাহিদ ফারুকী : সাহারা মরুভূমির বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী একটি আধা-যাযাবর জনগোষ্ঠীর নাম তুয়ারেগ। বছরের একটি বিশেষ সময়ে তারা তাদের পোষা জীবজন্তুসহ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করে। তাদের রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস, ভাষা, ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা, সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি এবং বিচিত্র জীবনযাপন প্রণালী।
অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে, মোটর গাড়ি চালু হবার আগে এরা যখন উটের বহর নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেত তখন কখনো কখনো এক শ্রেণির অন্ধ উট চালক সম্পূর্ণভাবে তাদের ঘ্রাণশক্তি ও স্বাদগ্রহণের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে প্রতিমুহূর্তে পাল্টে যাওয়া পথচিহ্নহীন মরুভূমিতে নিরাপদ পথের সন্ধান দিত।
তুয়ারেগরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হলেও পশুপালক এই জনগোষ্ঠীর রয়েছে অনেক প্রাচীন লোকজ বিশ্বাস ও লোকাচার। সেজন্য ইসলামি সামাজিক রীতিনীতি থেকে তাদের রীতিনীতি অনেকটাই আলাদা। হাজার বছরের পুরনো এই জনগোষ্ঠীর লোকেদের বলা হয় বিশ্বের সর্বশেষ যাযাবর জাতি। তারা তামাশেক নামে একটি ভাষায় কথা বলে। সে ভাষার বর্ণমালার নাম টিফিনাগ। এই ভাষা কোনো স্কুল-কলেজে শেখানো হয় না, তবে তুয়ারেগরা ব্যক্তিগত তথ্য লিখে রাখতে, প্রেমপত্রে বা অলংকরণের কাজে তাদের ভাষা ব্যবহার করে। তুয়ারেগদের কাব্য, সঙ্গীত ও নৃত্যের সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। বেশিরভাগ সঙ্গীতই আবার নারীদের প্রশংসা করে রচিত। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তুয়ারেগ পুরুষরা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হলেও যখন কোনো গোত্র প্রধান মারা যান তখন তার বোনের ছেলে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হয়। তাদের বহনযোগ্য বসতঘরের মালিকানাও স্ত্রীর। উট, ছাগল বা ভেড়ার পাল থাকে স্ত্রীর মালিকানায়। ফলে এই সমাজে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকেন। পরিবারের পরিচিতিও হয় স্ত্রীর বংশের পরিচয়ের ভিত্তিতে।
তুয়ারেগ পুরুষেরা সাধারণত উটের পিঠে করে যাতায়াত করে। তবে নারীরা কোথাও যেতে হলে গাধায় চড়ে যায়। বাচ্চারাও গাধায় করে পানি সংগ্রহ করে। তুয়ারেগ নারীরা যেসব রূপার অলংকার ব্যবহার করে সেগুলো কেবল পুরুষেরাই তৈরি করে। আর নারীরা চামড়া ও খড়ের ব্যবস্থাপনা করে থাকে।
মুসলিম সমাজে পুরুষের সামনে নারীরা মুখ ঢেকে রাখে। কিন্তু তুয়ারেগ সমাজে ঘটে এর উল্টোটাই। নারীর সামনে পুরুষেরা মাথায় এক ধরনের নীল রঙের পাগড়ি পরে এবং পাগড়ির কাপড় দিয়ে মুখম-ল ঢেকে রাখে। সেজন্য তাদেরকে অনেক সময় ‘সাহারার নীল মানুষ’ বলেও সম্বোধন করা হয়। কিন্তু নারীদের মুখ ঢাকার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ পুরুষেরা তাদের নারীদের সুন্দর মুখ দেখতে চায়। তুয়ারেগ নারীদের এতটাই স্বাধীনতা রয়েছে যে, তারা বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরেও পুরুষ সঙ্গী রাখতে পারে। তালাক হলে স্বামী ও স্ত্রী কে কি সম্পদ পাবে সেই সিদ্ধান্ত স্ত্রীই গ্রহণ করেন। আবার তালাকপ্রাপ্ত নারীর বাবা-মা তাদের মেয়ের জন্য তালাক-উৎসবের আয়োজন করেন। এর ফলে এই সমাজে তালাকের ঘটনা প্রায়শ ঘটে। তালাকের পর সন্তানেরা মায়ের সঙ্গেই থাকে। অর্থাৎ তুয়ারেগ সমাজে নারী হলো খুবই সম্মানিত সদস্য। শাশুড়িরা তাদের জামাইদের কাছে এতটাই সম্মানের পাত্রী যে, তারা শাশুড়ির উপস্থিতিতে এক ঘরে খাবারও খায় না।
মাত্র ১০ থেকে ১৫ লাখ জনসংখ্যার এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আলজেরিয়া, পশ্চিম লিবিয়া, নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ নাইজার, বুরকিনা ফাসোর কিছু অংশ এবং মালির পূর্বাঞ্চল। নিজেদের কোনো স্বাধীন দেশ না থাকলেও তাদের বসবাসের অঞ্চল বা ছিটমহলগুলোর নিজস্ব নাম রয়েছে। এরা উত্তর আফ্রিকার বারবার জাতির উত্তরসূরি এবং লিবিয়ার ফেজান অঞ্চল থেকে তাদের বিকাশ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। তুয়ারেগদের মধ্যে বিভিন্ন উপগোষ্ঠী বা ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠী রয়েছে।
তুয়ারেগরা ফরাসি উপনিবেশের অধীন ছিল। ১৯১৭ সালে তারা ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু ফরাসিরা প্রচ- নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তাদের দমন করে। ১৯৬০ দশকের শুরুর দিক থেকে তুয়ারেগদের বসবাসের এলাকায় বিভিন্ন আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সৃষ্টি হতে থাকলে তুয়ারেগরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারাতে থাকে। ১৯৮৪-৮৫ সালের প্রচ- খরার সময় তুয়ারেগদের মধ্যে কিছু লোক লিবিয়ায় চলে যায়। সেখানে তারা অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে তারা নিজ বাসভূমিতে ফিরে আসে এবং তাদের অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। ওই সময় থেকে মালি ও নাইজারের কিছু অংশে গেরিলা যুদ্ধ চলছে। মৌরিতানিয়ায় কিছু তুয়ারেগকে উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়েছে। সূত্র : ইন্টারনেট