আসুন জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করি
মাহফুজ আল মাদানী: জানা, বুঝা, উপলদ্ধি করা। ইংরেজিতে ঝপরবহপব, কহড়ষিবফমব, খবধৎহরহম বলে। ‘কোনো কিছু সম্পর্কে যাবতীয় তত্ত্ব ও তথ্যানুসারে সম্যক জ্ঞানার্জন করা’। ইলিম বা জ্ঞান হচ্ছে আত্মার এমন এক শক্তি ও যোগ্যতার নাম, যা দ্বারা ব্যক্তি ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে। জ্ঞানার্জনের জন্য আল্লাহপাক কুরআনুল কারিমের প্রথম আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘পড় তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ -(সুরা আল আলাক্ব : ০১)। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমের প্রথম আয়াতে পড়ার কথা উল্লেখ করে জ্ঞানার্জনের গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া মানবজাতিকে অন্যান্য সকল জাতি থেকে জ্ঞানের কারণে মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই, জ্ঞানার্জন অতীব গুরুত্ববহ একটি কাজ। ইলিম বা জ্ঞান প্রধানত দুই প্রকার। দ্বীনি বা ধর্মীয় জ্ঞান। যথা কুরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকহ. ফারাইজ ইত্যাদির জ্ঞান। দুনিয়াবী জ্ঞান। যথা বাংলা, ইংরেজি, রসায়ন, পদার্থ ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান।
জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ’ -(ইবনে মাজাহ)। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কোন ধরনের জ্ঞানার্জন করা ফরজ এবং এর পরিমাণ কতটুকু? তার উত্তরে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদগণ বলেন, এখানে ফরজ বা আবশ্যক জ্ঞানার্জন দ্বারা দ্বীনি বা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন উদ্দেশ্য। দৈনন্দিন জীবন চলার জন্য একজন মানুষের পক্ষে ইবাদত এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যতটুকু জ্ঞানার্জন না করলে সঠিকভাবে জ্ঞানার্জন অসম্ভব ততটুকু জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ তথা আবশ্যক। কেউ কেউ বলেছেন, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, হারাম, হালাল, মুবাহ, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদির জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজে আইন। মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সর্বদা এগিয়ে থাকা চাই।
জ্ঞানের মর্যাদা সর্বদা সবখানে উচ্চাসনে আসীন। তাই জ্ঞানীর কদর, সম্মান কোথাও ভূলুণ্ঠিত হয় না। জ্ঞানের মর্যাদা বর্ণনায় আল্লাহর বাণী, ‘যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা’ -(সুরা আল মুজাদিলাহ : ১১)। জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ হতে এক মহান দান। এটা বান্দার জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিরাট করুণা। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান দেওয়া হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দেওয়া হয়েছে’ -(সুরা আল বাক্বারা : ২৬৯)। যারা জ্ঞানী-বিজ্ঞানী তারাই তো জানে। আর যারা জানে তারাই তো প্রভূত কল্যাণের অধিকারী। আর যার জানে এবং যারা জানে না, তারা কখনো সমান হতে পারে না। আল্লাহ নিজেই বলেন, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? -(সুরা আয যুমার : ০৯)। অর্থাৎ তারা কখনো সমান হতে পারে না। এতে স্পষ্টই বোধগম্য যে, জ্ঞানের মর্যাদা উচ্চাঙ্গে। তাই তো প্রবাদ বাক্যে রয়েছে, ‘মূর্খ বন্ধুর চেয়ে জ্ঞানী শত্রুও উত্তম’। জ্ঞানের মর্যাদা এতই যে, যাকে ইচ্ছা তাকে দেওয়া হয় না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের সুক্ষ্ম জ্ঞান দান করেন’ -(বোখারী)। জ্ঞানার্জন করা মানে আল্লাহর পথে চলা। আর জ্ঞানার্জনকারীর সম্মানে আল্লাহর ফেরেশতাগণ তাদের পাখা বিছিয়ে রাখেন। প্রার্থনা করে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিকূল।
গভীর পানির মাছও জ্ঞানার্জনকারীর জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত আবু দারদা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করার উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে, এর উসিলায় আল্লাহ তায়ালা তাকে বেহেশতের পথসমূহ হতে একটি পথে পরিচালিত করেন। নিশ্চয়ই জ্ঞানার্জনকারীর সন্তুষ্টির জন্য ফেরেশতাগণ তাদের পাখাসমূহ বিছিয়ে দেন। আর আলেমের জন্যে আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি গভীর পানির মাছও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। সুতরাং একজন আবেদের উপর আলেমের মর্যাদা তেমনি, যেমন পূর্ণিমার রাতে সকল তারকার উপর চাঁদের মর্যাদা। নিশ্চয় আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ কোনো দিনার এবং দিরহামের উত্তরাধিকারী রেখে যাননি। বরং তারা শুধুমাত্র ইলিম তথা জ্ঞানকে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন। সুতরাং যে জ্ঞানার্জন করল সে পরিপূর্ণ অংশ গ্রহণ করল’ -(আহমদ, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী)।
জ্ঞানার্জন হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্যে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া জ্ঞানার্জন করলে কিয়ামত দিবসে তা কোনো উপকারে আসবে না। যেদিন জান্নাতে যাওয়ার আশা পোষণ করবে সবাই সেদিন জান্নাত পাওয়া দূরের কথা বরং জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। হাদিসের ভাষ্যমতে, ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এমন ইলিম শিক্ষা করে যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সে-ই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে দুনিয়ার কোনো সামগ্রী লাভের উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা করল কিয়ামত দিবসে সে জান্নাতের সুগন্ধি তথা গন্ধও পাবে না’ -(আহমদ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)। একজন আবেদের চেয়ে একজন আলেম তথা জ্ঞানার্জনকারী উত্তম। তাই তো জ্ঞানার্জন করা নফল ইবাদত করার চেয়ে মর্যাদাবান। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাতের কিছু সময় জ্ঞানচর্চা করা সারারাত জেগে থাকা (এবং নফল ইবাদত করা) হতে উত্তম’ -(দারেমী)।
আমাদের সমাজের লোকদের আরও বেশি জ্ঞানী করে তুলতে হবে। জ্ঞানের মাধ্যমে ভাল-মন্দ পার্থক্য নির্ণয় করা সক্ষম হবে। সমাজের মন্দ কাজগুলো দূর করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা হবে আলোকবর্তিকা স্বরূপ। তবে, এক্ষেত্রে সুশিক্ষার বিকল্প নেই। নৈতিক শিক্ষার প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে সমাজের মানুষদেরকে চরিত্রবান করে তুলতে হবে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ যখন আদর্শবান হবে তখনই সমাজ হবে আদর্শময়। এক্ষেত্রে সুশিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। আসুন আমরা সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে সুশিক্ষিত করে সমাজকে আদর্শময় করে গড়ে তুলি।
লেখক: এম. ফিল গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান