বেইজিং কি হংকং-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে
ক্রিস প্যাটেন : চীনকে কি বিশ্বাস করা যায়? ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসাবে হংকংয়ের শেষ বছরগুলিতে আমি এখানকার গভর্নর ছিলাম। সে সময় হংকংয়ে মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে গণতন্ত্রের উন্নয়ন প্রসঙ্গে বেইজিংয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দফায় দফায় আমার আলোচনা হয়েছে। তখন লোকেরা প্রায়শই আমাকে বলেছে যে, একবার যদি চীনা কর্তৃপক্ষ কোনো চুক্তিতে পৌঁছে তাহলে তারা তার ওপর বহাল থাকে। তখনই আমার মনে হয়েছে যে, এই দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো বিশ্বাস প্রসূত, বাস্তবতার নিরিখে তৈরি নয়। আর সেটাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন তার অন্যসব উপনিবেশকে স্বাধীনতা দেয় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু তারা ব্যবসা কেন্দ্র হংকংকে নিজেদের অধীনেই রেখে দেয়। এখানে একটি সক্রিয় সুশীল সমাজ এবং আইনের শাসনসহ অবাধ বাণিজ্যের সফল বিকাশ ঘটে। আর ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পর হংকং ছিল চীনের মূল ভূখ- থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত মানুষের শেষ ভরসাস্থল।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা ব্রিটেনকে হংকংয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেন। তারা স্থানীয় অধিবাসীদের এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন যে, সিঙ্গাপুরের মতো তাদেরও একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ রয়েছে। আর ব্যবসায়ী সমাজ ব্রিটেনকে আশ্বাস দেয় যে, তারা রাজনীতিতে আগ্রহী নন এবং শুধু ব্যবসা নিয়েই থাকতে চান। তারা হয়তো এমন ভয়ে ছিলেন যে, নির্বাচন হলে নতুন প্রশাসন সম্পদের পুনর্বণ্টনের উদ্যোগ নিতে পারে। ১৯৯৭ সালে হংকংয়ের ওপর ব্রিটেনের ইজারার মেয়াদ শেষ হয়ে আসার বছরটি ঘনিয়ে আসার সময় ব্রিটিশ ও চীনা কর্তৃপক্ষ হংকংয়ের সার্বভৌমত্ব বেইজিংয়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
১৯৮০র দশকের শুরুর দিকে চীনের অবিসংবাদিত নেতা দেং জিয়াও পিং ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ শীর্ষক সূত্র উদ্ভাবন করেন। এতে বলা হয় যে, হংকং চীনের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে কিন্তু সেখানে স্বায়ত্ত শাসন এবং প্রচলিত জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখা হবে।
১৯৯২ সালে আমি গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে আসার পর হংকংয়ের সর্বশেষ ঔপনিবেশিক সরকার এখানকার স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা এবং সুশীল সমাজকে রক্ষার জন্য সম্ভব সব ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। আমরা হংকংয়ের বহুত্ববাদী সমাজকে রক্ষায় এবং শহরটিকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করে তোলার জন্য আইন তৈরি করি। এগুলি ছিল খুবই নমনীয় ধরনের পদক্ষেপ। কিন্তু এর ফলে আমার মাথার ওপর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অব্যাহত চাপ আসতে থাকে।
ওই সময় আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে, হংকংয়ে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালাতে দেয়া খুবই নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। কারণ এর ফলে এখানকার গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সমর্থন তিরোহিত হবে এবং শহরটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থীদের কূটচালের শিকারে পরিণত হবে।
অন্যদিকে বেইজিং কখনই হংকংয়ের পৃথক জীবনযাত্রা প্রণালীকে সত্যিকারভাবে বুঝতে পারেনি। তারা ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ নীতি নিয়ে অনেক কথা বলে কিন্তু হংকংয়ের পদ্ধতিটা বোঝার জন্য তেমন কোনো চেষ্টাই করেনি। চীনের কাছে হস্তান্তরের পর বেইজিং সবচেয়ে যে খারাপ কাজটি করেছে সেটা হলো, হংকংবাসীকে নিজেদের নির্বাচনি ব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দিয়েছে। অথচ হস্তান্তরের চুক্তিতে এই সুযোগ দেয়ার অঙ্গীকার করেছিল বেইজিং। এর পরিবর্তে চীনা কমিউনিস্টরা সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করে।
শি জিনপিংয়ের সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আরও পদক্ষেপ নিয়েছে। হংকংয়ে বেইজিং কর্তৃপক্ষের দফতর স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকা-ে বারবার হস্তক্ষেপ করছে। স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং আইনের শাসনের ওপরও আঘাত হেনেছে বেইজিং। চীনের সমালোচনা করে বই প্রকাশের দায়ে প্রকাশকদের এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নীতির সমালোচনাকারী একজন কোটিপতিকে অপহরণ করা হয়। স্থানীয় গণমাধ্যম এবং বিশ্ববিদ্যালয় চীন সমর্থকদের চাপের মুখে পড়ে। হংকং একটি ছোট্ট জায়গা হতে পারে, কিন্তু এর ভাগ্যে কী ঘটছে তা একবিংশ শতাব্দীর অনেকটা জুড়ে প্রভাব রেখে যাবে। আর এখানে যা ঘটবে তার থেকেই জবাব পাওয়া যাবে যে, বেইজিংকে কি বিশ্বাস করা যায়?
(লেখক পরিচিতি : ক্রিস প্যাটেন, হংকংয়ের সর্বশেষ গভর্নর এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর) সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ মুজতাহিদ ফারুকী, সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ