প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নতি করতে আর কতদিন?
মো.ওসমান গনি
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা অর্জন করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। একজন মানুষকে সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই সবার জন্য চাই সুশিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নতিকরণ নিয়ে আজ অনেকদিন যাবৎ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ দুইয়ের মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা দেখা যায় তা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। কেন এমনটা হবে? সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দুটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে যদি এমন হয় তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোন দিকে যাবে? দুটি মন্ত্রণালয় নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। ছয় বছর আগে শিক্ষানীতিতে তা বলা হলেও বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন কার্যক্রমে নেই সমন্বয়। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যা ও শিক্ষক সংকট দূর করার উদ্যোগ এগোচ্ছে খুব ধীরগতিতে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে বিভিন্ন এলাকায় অনিয়মের অভিযোগও উঠছে। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে। এতে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার বোঝা খুদে শিক্ষার্থীদের কাঁধ থেকে কবে সরবে, এর উত্তর নেই প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার স্তর হলে পাঠ্যসূচি কেমন হবে, তা এখনো জানে না গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্ব এখনো পায়নি। ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে পাঠ্যক্রম সাজানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও পাঠ্যবই বিতরণের দায়িত্ব হবে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এ ছাড়া শিক্ষানীতির ঘোষণা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে সারাদেশের ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভয়াবহ অবকাঠামো সংকট। গত চার বছরের মধ্যে মন্ত্রণালয় মাত্র সাড়ে সাতশত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। দেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৬০১টি। বাকিগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন কত সালের মধ্যে সম্ভব, এ প্রশ্নের উত্তর জানেন না মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষিত সময়ের মধ্যে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অভিজ্ঞরা। গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পেলেও প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা যাচ্ছে না। মন্ত্রিসভার অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্বে থাকছে।
তথ্যমতে, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করতে হবে। যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন কিলোমিটারের মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই, শুধু সেসব বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অনুমোদন দেবে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কার্যক্রমেও গতি আনতে পারছে না মন্ত্রণালয়। ঢিমেতালে চলছে কার্যক্রমটি। গত চার বছরের মধ্যে মন্ত্রণালয় মাত্র ৭৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করেছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৪৯১টি, ২০১৪ সালে ১৯২টি, ২০১৫ সালে ৭৭টি ও ২০১৬ সালে ৪টি।
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, চলতি শিক্ষা বছরে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৩ (পিইডিপি-৩) এর আওতায় সারাদেশে ২০০ বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অবকাঠামোগত কাজ চলছে। গত বছর তিন হাজার ২৪৬টি বিদ্যালয়ে বড় ধরনের মেরামত হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ৩১৮টি বিদ্যালয়ে বড় ধরনের মেরামত করা হবে। গত বছর দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার ৪০৪টি কক্ষ নির্মিত হয়েছে। নির্মাণাধীন ছয় হাজার ৪০৭টি আর কার্যাদেশ দেওয়ার অপেক্ষায় আছে পাঁচ হাজার ৩৫৯টি। এমন ধীরগতিতে কার্যক্রম চলতে থাকলে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণ কখন শেষ হবে, এ প্রশ্নের ঠিক উত্তর প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও দিতে পারছেন না। অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়া বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মাত্র ৫০০টিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই পড়ানোর জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ পর্যন্ত কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। কোনো বিদ্যালয়েই নেই বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক। নতুন শিক্ষক নিয়োগও দেওয়া হয়নি। সারাদেশের বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক সংকট। ফলে অনেক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে মানসম্পন্ন বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বিভিন্ন ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য দশটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। (চলবে-১)
লেখক:সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান