রাস্তা-ঘাট হচ্ছে, আইটি পার্কও হচ্ছে, কিন্তু বাংলা হচ্ছে না
ফিরোজ আহমেদ
আদিবাসীদের নিয়ে একটা মর্মান্তিক স্মৃতির কথা বলি, আগেও একবার লিখেছিলাম এটার কথা। এমনিতেই জমজমাট মেলা, তাও বারোয়ারি পূজাম-পে স্থানীয় সাঁওতাল নারীরা দলবেঁধে এসে নেচে-গেয়ে ভক্তি নিবেদন করে ফেরত যায় এই দৃশ্যটার জন্য বিশেষভাবে অপেক্ষা করে সকলে। তো, বছর দুয়েক আগে সেবারই তারা প্রথমবার আসেনি। কেউ বলছেন ওরা এখন ইশকুলে যায়, আগের দিন কি আর আছে। কারও আক্ষেপ এত বছরের একটা ঐতিহ্য! অদ্ভুদ অভিজ্ঞতাটা হলো সন্ধ্যায় দিকে। পোশাক-আশাকে বোঝা গেল স্থানীয়, তিনজনই টলছে, একজন মৃদু জড়ানো গলায় শুধোচ্ছে কি রে, তোদের মেয়েরা যে এবার আসল না যে? এত মানুষ দেখতে আসল… যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সে একদম চুর, পাটকাঠির মতো শরীর, গা শিওরানো সেই উত্তরটা দিল: মোসলমানের দ্যাশ, হেদুগোর পূজা, সাঁওতালের কি! বাঙালির দেশে ধর্ম বিভাজন, বর্ণবিভাজনেরও বাইরে আর যে একটা অস্তিত্বহীনতার উপলব্ধি বরাদ্দ আছে বাকি জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য, সেটার মতো অসহায়ত্ব বোধহয় আর কোনকিছুতে নাই।… প্রায় একই রকম একটা অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ আহমেদ কামাল। পুলিশ সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে, গত বছর এই দৃশ্য দেখে আহমেদ কামালের গল্পটা স্মৃতিতে জেগেছিল। উত্তরবঙ্গের এক আদিবাসী পল্লীতে রাতের গানের আড্ডায় তিনি শুনেছিলেন এক বৃদ্ধ সাঁওতাল গান গাইছে, ‘রাস্তা হইলো ঘাট হইল… বাংলা হইলো না।’
সাঁওতালরা নীরবে শুনছিলেন নিজেদের বঞ্চনা আর স্বপ্নভঙ্গের এই হাহাকার। বাংলা হলে সাঁওতালও ভাল থাকবে, সব ঠিক হয়ে যাবে, এই আশ্বাসবাণী শুনেছিলেন সেই আদিবাসী। সেই বাংলায় উচ্ছেদ হবে না, আগুন লাগবে না, লাঠিয়াল আসবে না, পেটপুরে খাবার মিলবেÑ এই ছিল তার স্বপ্ন। তারপর কতযুগ গেল, রাস্তা হলো, উন্নয়ন হলো, দালান হলো, বাংলা আর হলো না। এই স্মৃতি নিয়ে আহমেদ কামাল একটি কবিতাও লিখেছিলেন। আগুন কিন্তু খুব দূরেও না, বিদেশি নগর বানাবার প্রকল্পে আগুন তো খোদ ঢাকার বুকেও একে একে জ্বলছে। গরিব হলেও বস্তিবাসীটি বাঙালি বলেই হয়তো, আগুনটি চক্ষুলজ্জা বশত লাগছে গোপনে। সাঁওতালের বিষয়ে ততটুকু শরমও নেই। প্রকাশ্যে, ভোরবেলার ঝলমলে রোদে সবার চোখের সামনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই দৃশ্য। কিন্তু উন্নয়নের এই আগুন পুড়িয়ে মারছে বাংলাবাসী সাঁওতাল, বস্তিবাসীÑ গরিব নির্বিশেষে সবাইকে।
আগুনে পোড়া মাটিতে রাস্তা হচ্ছে, ঘাট হচ্ছে, আইটি পার্কও হচ্ছে, কিন্তু বাংলা হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তরুণদের চাকরি তো মিলছে না। প্রতিদিন সকালে তাই দেখি কর্মহীন দিনমজুরের অপেক্ষমান সারি বাড়ছে। বাংলার সম্পদ মোঘলরা নিয়ে যেত, পর্তুগিজ- ইংরেজও নিত, নিত পাকিস্তানিরা। তাদের সবাইকে খেদিয়ে এখন কে সোনার বাংলায় শ্মশানের রাজত্ব কায়েম করল!
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন