বন্ধু হবে কে?
া রুহুল আমিন ভূঁইয়া
মানুষ সামাজিক জীব। এর মানে হলো, মানুষ একা হলেও সে একটি সমাজের অংশ। সমাজ গড়ে ওঠে সমষ্টিকে নিয়ে, একাকি সমাজ গঠিত হয় না। সমাজে বিচিত্র শ্রেণির মানুষ বাস করে। একেক জনের পেশা একেক রকম। তাই সমাজে একজনকে আরেক জনের প্রয়োজন পড়ে। এটা আল্লাহর এক অশেষ নিয়ামত। কেননা সমাজবদ্ধতার প্রশ্নে মানুষ একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। সঠিক ভাবে যথার্থ বন্ধু নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে মানুষ তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সুষ্ঠু ও নিরাপদ করে তোলে। এই বন্ধুত্বের ব্যাপারে ইসলামের রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। আপনাদেরও নিশ্চয়ই অনেক বন্ধু আছে এবং তাদের সাথে কথা বলেন, তাদেরকে দেখতে যান, তাদের সাহায্যে এগিয়ে যান এবং তারাও আপনার দুঃসময়ে নিশ্চয়ই আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসে! কারো কারো বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা প্রচুর। আবার অনেকেই কয়েক জন বন্ধু নিয়েই তৃপ্ত, সন্তুষ্ট। অবশ্য এটা স্পষ্ট যে, বন্ধুদের মাঝে অনেকেই আছে খুবই আন্তরিক এবং সুহৃদ, ঘনিষ্ঠ এবং দুর্দিনে সাহায্যের হাত সম্প্রসারণকারী।
ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুর মর্যাদা অনেক উপরে। এমনকি মানুষের সৌভাগ্যের ওপরও বন্ধুত্বের প্রভাব পড়ে। এজন্যেই নবী করিম (সা.) এবং তাঁর উত্তর প্রজন্মের ইমামগণ বন্ধু নির্বাচন করার ব্যাপারে মূল্যবান কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ‘একটি মানুষ তার বন্ধুর ধর্মের অনুসারী হয়, তাই সবার ভেবে দেখা উচিত কার সাথে বন্ধুত্ব করবে।’ অন্যভাবে রাসুলে খোদা (সা.) বন্ধুত্বকে এতো বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বলে মনে করেন যে বন্ধুত্ব আপন সহচরকেও নিজের ধর্মে নিজের আকিদা বিশ্বাসের দিকে নিয়ে আসে। তাই সহচরের গুরুত্ব বিশেষ করে উত্তম বন্ধুর গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে নবীজী বলেছেন, ‘একাকী নিঃসঙ্গতার চেয়ে ভালো বন্ধু উত্তম আর নিঃসঙ্গতা মন্দ বন্ধুর চেয়ে উত্তম।’ তার মানে হলো, ভালো এবং যথার্থ বন্ধু যদি নাও থাকে তাহলেও তা একজন মন্দ ও অযোগ্য বন্ধু থাকার চেয়ে ভালো। বন্ধু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আগে পরে বিচার বিবেচনা করে নেওয়া উচিত।
কারো প্রতি মন আকৃষ্ট হলেই তার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে এমনটা ঠিক নয় বরং প্রথমে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে ভালো লাগা বা তার প্রতি আকর্ষণের কারণ কিংবা উৎসটা কী এবং সে আদৌ বন্ধু হবার যোগ্য কি না ইত্যাদি। হঠাৎ করে কারো সাথে পরিচিত হবার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ কোনো রকম বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে অনেক সময় দুঃখজনক পরিণতি ঘটতে পারে। অনেক ইন্টারনেট বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুব সহজেই অনুমান করা যায়। যাই হোক, এই যে আমরা বিচার বিবেচনার কথা বললাম, ইসলাম এ সম্পর্কে কী বলে অর্থাৎ একজন ভালো বন্ধুর গুণাবলী কী ইসলামের দৃষ্টিতে সেদিকে একবার নজর দেওয়া যাক। ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐ বুদ্ধি বিবেককে কাজে লাগানো। এই বিবেকবান বন্ধু সদুপদেষ্টা হয় এবং তার ওপর সবসময় আস্থা রাখা যায় কেননা এ ধরনের বন্ধু ভুল ত্রুটি থেকে ফিরিয়ে রাখে। বিবেক-বুদ্ধিমান বন্ধুদের সাথে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বহু বর্ণনা রয়েছে। ইমাম আলী (আ) বলেছেন, বিবেকবান বন্ধুর সাহচর্য অন্তরাত্মাকে প্রাণচাঞ্চল্য দান করে। বিবেকবান বন্ধু মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং মানুষকে ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে। পক্ষান্তরে অজ্ঞ এবং মূর্খ বন্ধু কারো কোনো উপকার তো করেই না বরং তার কথাবার্তা আর আচার আচরণ অন্যদের বিরক্তি আর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নৈতিক উপযুক্ততা ভালো বন্ধুর অপর একটি গুণ। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী ভালো বন্ধু সেই হতে পারে যে নৈতিক স্খলন থেকে দূরে থাকে। কেননা দুশ্চরিত্রবান আর মন্দ কাজে অভ্যস্ত বন্ধু শেষ পর্যন্ত মানুষকে অবৈধ, অশোভন আর অনৈতিক কাজের দিকে নিয়ে যায়। পবিত্র কোরআনের নূরানী আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, যে বিচ্যুত এবং ফাসেকের সাথে বন্ধুত্ব করে সে আসলে নিজের ওপর নিজেই জুলুম করে। কিয়ামতের দিন তাদের অবস্থা সম্পর্কে কোরআন বলেছে, ‘হায় আমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে বন্ধু রূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল।
শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোঁকা দেয়।’ বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, সে-ই অধম যে চলে তফাতে।’ অর্থাৎ যে ভালো, তার কোনো বয় নেই, সে ভালো-মন্দ সবার সাথেই বিনা দ্বিধায় চলতে পারে, কেননা সে খারাপ হবে না, খারাপের মাধ্যমে প্রভাবিত হবে না। তাই যে মন্দের প্রভাবের আশঙ্কায় অধমকে এড়িয়ে চলে, সে নিজেই অধম। কিন্তু মনোবিজ্ঞান এই বক্তব্যের পক্ষে নেই। কেননা মানুষ কোনো পাথর নয় কিংবা নয় কোনো শুকনো কাঠ বিশেষ। যতোই সে চেষ্টা করুক না কেন অধমের দোষগুলো বা তার চিন্তাদর্শ থেকে অত্যন্ত সতর্ক ভাবে দূরে থাকতে, পারবে না। যারা সতর্ক থাকার কথা বলে তাদের ঐ বক্তব্য একান্তই ভ্রান্ত একটা দাবিমাত্র। কারণ কারো সাথে বন্ধুত্ব করলে মনের অজান্তেই তার কথাবার্তা, আচার আচরণ, কাজ কর্মের প্রভাব পড়বেই। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুদের সাথে আচরণ হতে হবে সদয়, আন্তরিক এবং বিনয়ী। তবে গঠনমূলক সমালোচনাও বন্ধুত্বের মাঝে বিদ্যমান অনিবার্য একটি শিষ্টাচার। হাদিসে এসেছে ‘এক মুমিন আরেক মুমিনের জন্যে আয়নার মতো।’
তাই বন্ধুর দোষত্রুটিগুলো শোধরানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করা শিষ্টাচার ভুক্ত। কেননা এতে মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। গঠনমূলক ভাবে বন্ধুরর দোষগুলো ধরে দিলে বন্ধু রাগ তো করবেই না বরং ভাববে সেই তোপরম শুভাকাক্সক্ষী। তাই তাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় আরো গভীর হবে। তবে কখনো ভুল করলে ক্ষমা চাওয়াটাও একটা শিষ্টাচার। কেননা ভুল স্বীকারের মধ্যেই রয়েছে সংশোধনের বীজ। ইমাম আলী (আ) এর ভাষ্য অনুযায়ী ‘সবচেয়ে মন্দ লোক হলো সে-ই যে ভুল স্বীকার করতে রাজি নয়।’