চিন্তকেরা আলাদা আলাদা স্বার্থকে ভাষা দেন
ফিরোজ আহমেদ
ফরহাদ মজহার তুলনারহিত চিন্তাবিদ, তার কথার জবাব দিতে কেউ পারে নাÑ এইসব কথাকেও চিন্তাশূন্য বলেই মনে করি। পৃথিবীতে কেউ কারও চেয়ে বড় চিন্তক নন, বা হলেও কিছু আসে যায় না। আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার পক্ষ নিই, তাতে সমর্থন দিই, তাকে শক্তি যোগাই। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এক একটা চিন্তা প্রাধান্য পায় কিংবা হারিয়েও যায়। ইতিহাসের একটা পর্বে তাই ইবনে রুশদ প্রধান চিন্তক, আরেকটা পর্বে গাজ্জালী সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী, অন্য একটা যুগে তাইমিয়া। একইভাবেই একই যুগে দুই ভিন্ন অংশ দুই আলাদা ব্যক্তিত্বে প্রধান দিশারী ভাববেন, এটাই স্বাভাবিক। পল সুইজি নাকি মিলটন ফ্রিডম্যান কাকে বড় চিন্তক মনে হবে, এইটা তাই ব্যক্তির ভিন্ন মতাদর্শ, অবস্থান আর চাওয়ার ওপর নির্ভর করে। চিন্তকরা আলাদা আলাদা স্বার্থকে ভাষা দেন, এইটুকুই। আনু মুহাম্মদ কিংবা জোনায়েদ সাকি আমাকে ভাষা দেন, ফরহাদ মজহার আরেকজনকে, সলিমুল্লাহ খান ভিন্ন আরেকজনকে। বড় ছোট মাপার মাপকাঠিটা কার হাতে? কারও কারও জন্য গাফফার চৌধুরীই তো যথেষ্ট দেখি, কেবলা কেবল ভিন্ন বলে।
ফরহাদ মজহারের চিন্তা দুর্বলতা ও ত্রুটি বিষয়ে তাই অতীতে বহুবার লিখেছি, ভবিষ্যতেও লিখব। এইটুকু ভূমিকা কেবল, আসল কথাটা তোলা যাক: ফরহাদ মজহারের নিরাপত্তার বিষয়টা তার ব্যক্তিগত কোনো বিষয় না। এটা একটা গণতান্ত্রিক, সহিষ্ণু রাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রাম। এটা রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের পরিসরটাতে রাষ্ট্রের দানবীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে নাগরিককে সুরক্ষার প্রশ্ন। ফলে এই বিষয়ে কথা বলে আমরা ব্যক্তিগতভাবে তার পক্ষাবলম্বন করি না, বরং সত্তা হিসেবে নাগরিকের অস্তিত্বটাকে রক্ষার সংগ্রাম করি। সেই জন্যই ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে হোক, গ্রেফতার করা ব্লগারদের মুক্তির দাবিতে হোক, সব খানে আমাদেরই মেলে। মোসাহেব কেবল মাখন রুটি হালুয়ার ভাগ খোঁজে।
এমনকি আমরাই আসলে রাষ্ট্রটাকেও রক্ষার চেষ্টা করি, সরকারগুলোর দুর্নীতির গ্রাস থেকে। তাই ভারত হোক, মার্কিন হোক, চীন হোক সবার হাত থেকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আর সম্পদকে রক্ষাতেও আমাদেরই মেলে। এই বিষয়টুকুই মোসাহেব আড়াল করার চেষ্টা করে। মোসাহেব তাই ৫৭ ধারার বিলোপ চায় নিজের সুবিধার জন্য, অন্যদের জন্য গুম-খুন-আতঙ্ক ছড়ানো, কোনোকিছুতেই তার আপত্তি নাই। বিষয় এইটুকুই। এইখানেই মোসাহেবের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য। মোসাহেব সবাইকে গফুর বানিয়ে দেবে, আত্মপরিচয় রক্ষা করতে চাইলে, রাষ্ট্রটাকেও বাঁচাতে চাইলে গণস্বার্থের এই রাজনীতিটুকু বোঝাটা জরুরি।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন