ফৌজদারিতেও এডিআর চালুর পরামর্শ বিচারকদের
এস এম নূর মোহাম্মদ : বিচার বিভাগীয় পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সময় সাপেক্ষ এবং আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ। কেননা বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরই আইনের ছকে বাঁধা। ফলে মামলা নিষ্পত্তি করতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হচ্ছে। এতে মামলার পক্ষগণের উপর একদিকে মানসিক চাপ বাড়ছে অন্যদিকে মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন অনেকে। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় কোনো কোনো দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১৫-২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। মামলা চলে কয়েক পুরুষ ধরে। দেশে বিরাজমান এ ধরনের পাহাড় পরিমাণ মামলার জট নিষ্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর জোর দেওয়া হয় গত কয়েক বছর আগে। এ লক্ষ্যে ২০০৩ সালে দেওয়ানি কার্যবিধিতে এডিআর ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সরকার। দেওয়ানি কার্যবিধিতে ধারা ৮৯এ এবং ৮৯বি সংযোজনের মাধ্যমে কোনো মামলা বিচারিক আদালতে এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিধান করা হয়। পরবর্তীতে ধারা ৮৯সি সংযুক্ত করে আপিল আদালতকে এডিআরের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তির ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ৮৯ডি এবং ৮৯ই ধারা সংযোজন করা হয়।
সর্বশেষ ২০১২ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে দেওয়ানি কার্যবিধিতে এডিআর ব্যবস্থার ক্ষেত্র ও পরিধি আরও সম্প্রসারিত করা হয়। আপস-মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি পূর্বে ঐচ্ছিক থাকলেও এ সংশোধনীর মাধ্যমে এটি বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে এরপরও এডিআর ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। এর সুফল সম্পর্কে বিচারক, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী-কেউই সঠিকভাবে অবগত নন। এমনকি এডিআর বা মধ্যস্থতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আদালত ব্যতিত এডিআর বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির স্বীকৃত কোনো আইনি কাঠামো নেই। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আইনজীবীদের প্রতি মামলার পক্ষগণের আস্থাও কম। এমনকি মধ্যস্থতা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পদ্ধতিগত বিষয়াবলি সম্বলিত কোনো বিধিমালাও নেই।
যার কারণে এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির জন্য লোকজন ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসছে না। তাই এডিআরকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আইনি সংস্কারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সৃষ্টি করার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া এডিআরকে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে এর স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গঠন করতে হবে। এটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারক ও আইনজীবীগণকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আর এডিআরের বিষয়ে বিচারপ্রার্থীরা সচেতন হলে এবং সবাই এগিয়ে এলে মামলাজট অর্ধেক কমে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ভবিষ্যতেও মামলাজট প্রকট হবে না বলে ধারণা তাদের। আর তাই দেওয়ানি কার্যবিধির পাশাপাশি ফৌজদারি কার্যবিধিতেও এডিআর ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিচারকরা।
গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগে বাধা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক কর্মশালায় বিচারকরা এ পরামর্শ দেন। গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনের প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বিচারকদের মতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি বাধ্যতামূলক করতে দেওয়ানি মামলায় ‘কস্ট ইমপ্লিকেশন’ এর বিধান রাখা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে ২০০৭ সালে আইন কমিশন থেকে পাঠানো ‘প্লি বারগিং’ চালু করা সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পরামর্শ দেন বিচারকরা।
আলোচনায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কাজী রেজাউল হক বলেন, বিদ্যমান মামলাজট নিরসনে এডিআরের বিকল্প নেই। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় যে কোনো স্তরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রয়োগে বিধান রাখতে আইনে সংস্কার আনতে পরামর্শ দেন তিনি। আর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, সিঙ্গাপুরে এডিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করে ৬০ ভাগ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে। তাই এডিআরের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। সেইসঙ্গে ফৌজদারি বিচার ব্যববস্থায় আপসযোগ্য মামলার সংখ্যা বাড়াতে পরামর্শও দেন তিনি।
নোয়াখালীর যুগ্ম জেলা জজ মো.শওকত হোসাইন বলেন, দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসারে বিবাদীপক্ষ লিখিত জবাব দাখিলের পরই কেবল বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। তবে এই বিধান পরিবর্তন করে যে কোনো স্তরে এডিআর প্রয়োগের অনুমোদনের জন্য পরামর্শ দেন তিনি। আর বিচারকদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আইনজীবীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান পাবনার যুগ্ম জেলা জজ বিশ্বনাথ ম-ল। কুমিল্লার যুগ্ম জেলা জজ মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন কবির ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি চালুর পাশাপাশি সকল ফৌজদারি মামলা আপসযোগ্য করার পরামর্শ দেন। চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম মাসুদ পারভেজ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আদালতের কজলিস্টে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেন। এছাড়া গাজিপুরের সিনিয়র সহকারী জজ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রতি জেলায় যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারককে মধ্যস্থতাকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব করেন।
এর আগে গত বছরের ১৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি কার্যকর করার জন্য দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়। কিন্তু এর (সংশোধনী) কার্যকর প্রয়োগ নেই। এটা কার্যকর করা গেলে মামলার জট কমবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, অসহায়দের আইনি সেবা দেওয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আইনজীবীদের ভূমিকা রাখতে হবে উল্লেখ করেন তিনি।
এর আগে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে এডিআর বা মীমাংসা পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ সংশোধন করে ২০১৩ সালে লিগ্যাল এইড অফিসারকে আইনি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সঙ্গে লিগ্যাল এইড অফিসারকে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এরপর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারগণ সংস্থার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে মীমাংসার মাধ্যমে বেশকিছু বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে। সম্পাদনা : উম্মুল ওয়ারা সুইটি