‘কাইল সকালে হইবোরে তোর বিয়া’
আমি অতবড় রোলিং দেখে খেই না পেয়ে সাড়ে ৩৬ মাত্রাতেই পিস ধরে ফেললাম। তাতে কোনো অসুবিধাই হলো না বেজ গিটারিস্ট-এর। কোনো এক অজানা মাত্রায় ও ধরে ফেলল। অন্ধের কিবা দিন, কিবা রাত্রি। লিড গিটারিস্টকে দেখলাম কাঁদো কাঁদো হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে আর মাত্রা খুঁজে ফিরছে গিটার ধরার জন্য। কোথায় ধরবে ঠিক বুঝতে পারছে না। আসলে কথা ছিল রোলিং হবে ১৬ মাত্রার, ড্রামার যে মাত্রাতিরিক্ত রোলিং করবে তা কেউ আমরা জানতাম না। কি আর করা গান তো শুরু করতে হবে, তা না হলে ১২০০ টাকা পাব কি করে। এবার আমার সেজো মামাত ভাইয়ের পালা। ও হলো সিঙ্গার। যেই স্কেল থেকে আমরা বাজাচ্ছি সেই স্কেলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রেখেই ভার্নিয়ার স্কেল থেকে ধরে ফেলল গান ‘কাইল সকালে হইব রে তোর বিয়া, দুঃখে আমার অন্তর ফাটে, তুই কি বুঝিস না। ওকি মরি হায় রে হায়, অহন করি কি উপায়, অহন মরতে চাইলে যায় নারে ম রাহা রাহা রাহা (এইটুকু ভাওয়াইর মতো)।’
গানের লাইনে অন্তর ফাটে শব্দটা শুনে মনে হলো বোম ফাটার মতো অবস্থা। অন্তর কি আর ঠাস করে আওয়াজ করে ফেটে যায়। তাড়াতাড়ি কোনোরকমে ওর স্কেলের সঙ্গে মিলিয়ে কি-বোর্ড বাজাতে শুরু করলাম। গানের কথা ‘অহন মরতে চাইলে যায় নারে মরা’, কথা সে রকমই, এত উঁচু স্কেল থেকে ও গান ধরেছে যে ওর নিজেরই মরার যোগাড় হয়েছে, তবুও গান না শেষ করে তো মরার কোনো উপায় নাই। মনে পড়ে গেল, একবার আমি আর আমার এক ব্যান্ড মেম্বার এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে এক গায়ক গান গাচ্ছিল। পুরো গানটাই কোয়াটার স্কেল নিচে গেয়ে শেষ করল অনান্য মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে। পুরো গানটা সুরের কোয়াটার স্কেল নিচে শোনার পর আমার মাথা ধরে গিয়েছিল। ব্যান্ড মেম্বার বলে উঠেছিল: টুলু ভাই বুকে ব্যথা হয়ে গেছে ওর গান শুনে। আসলেই সত্যি, কেউ যদি পুরো গানটাই বেসুরা গায় তাহলে শোনার পর কিন্তু সত্যি হয় মাথাব্যথা অথবা বুকে ব্যথা হবে। আমার সেজো মামাত ভাইদের অনুষ্ঠানে কিন্তু আমারও বুকে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার জীবনে সবচাইতে বেশি ভয় পেয়েছিলাম ওই অনুষ্ঠানে। আমার সেজো মামাত ভাই প্রতি অন্তরায় স্কেল চেঞ্জ করছে আর আমি ওর সঙ্গে সঙ্গে স্কেল খুঁজে বেড়াচ্ছি। মেজো মামাত ভাই ছোট কালে যে কর্ড শেখানো হয়েছিল অর্থাৎ গানের আসল কর্ড বাজিয়ে যাচ্ছে। ওর সঙ্গে সঙ্গে যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে লিড গিটারিস্ট আদিম কর্ড বাজিয়ে চলেছে যা সে প্র্যাকটিসে শিখেছিল অর্থাৎ যা আমাদের সবার বাজানোর কথা ছিল। সব চাইতে রহঃবৎবংঃরহম বিষয় হলো ড্রামার রুবেলÑ ওর একটাই তাল জানা ছিল এবং ওই একটা তালই সে বাজাত তা সে আজম খানের গান হোক কিংবা দিলরুবা খানের গান, আর সেটা হলো ‘বুক ফাস, বুক বুক ফাস’। এই ‘বুক ফাস, বুক বুক ফাস’ ছন্দটা আসলে কাহারবা তালে পড়ে। কিন্তু ওদের গান ‘কাইল সকালে হইব রে তোর বিয়া’ ছিল খ্যামটা তালে। এখন ভেবে দেখেন খ্যামটা তালের গানে কেউ যদি কাহারবা তালের ‘বুক ফাস, বুক বুক ফাস’ বাজায়, তাহলে কি নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারে স্টেজে। একদিকে সেজো মামাত ভাই, একদিকে আমি, একদিকে মেজো মামাত ভাই, একদিকে লিড গিটারিস্ট আর তার সঙ্গে সঙ্গে ছলছে ‘বুক ফাস, বুক বুক ফাস’। আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছিল। জীবনে এত বুকে ব্যথা কোনোদিন হয় নাই। তবে হ্যাঁ, গানটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ান মোর ওয়ান মোর করতে দর্শকরা পাগল হয়ে গেলÑ তবে শুধু প্রথম দুই সারির দর্শক। বাকি পুরো হলের দর্শক ¯্রােতারা শোকে মুহ্যমান। ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না ‘কি দেখিলাম, কি হেরিলাম’। ওদের কোনোকিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই ওরা শুরু করে দিল ওদের দ্বিতীয় গান। আবার রুবেল তার সেই ‘বুক ফাস, বুক বুক ফাস’ শুরু করে দিল, সঙ্গে আমরা আমাদের যা জানা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপায়া পড়লাম। রুবেল আসলে ওই একটা তালই জানত সুতরাং ওকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নাই। দ্বিতীয় গানটা শুরু হওয়ার পরপরই দর্শক সম্বিত ফিরে পেল এবং নো মোর, নো মোর, অফ যা. অফ যা, ধুও ধুও, ভুয়া ভুয়া বলে চিৎকার করতে থাকল। সামনের সারির ওরা কিন্তু ওয়ান মোর ওয়ান মোর করেই চলেছে। ওদের কানে গান ঢুকছে না কারণ ওরা তো ওয়ান মোর ওয়ান মোর করতেই ব্যস্ত, গান শুনবে কখন। তখন বুঝতে পারলাম যে ওরা আর কেউ না, আমার মামাত ভাইদের বন্ধুবান্ধব। একটু পরে দেখলাম দু-তিনজন শিক্ষক এসে ওয়ান মোর ওয়ালাদের খুব বকাবকি করল এবং এক পর্যায়ে ওদের বের করে দিল হল থেকে। স্টেজে আমাদের ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালেন শিক্ষকরা এবং আমাদের শেষ করতে ইশারা দিতে থাকলেন। আমার খুবই খুশি লাগল অনুষ্ঠান শেষ হওয়াতে কারণ পাঁচজন পাঁচদিকে দৌড়ালে কি আর অনুষ্ঠান করা যায়? শিক্ষকরা এক পর্যায়ে মারমুখি হয়ে স্টেজে উঠে আসলেন জোর করে ওদের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলেন। আমার জীবনে শান্তি ফিরে এলো। (চলবে-০৫)
লেখক: কলামিস্ট ও সঙ্গীতশিল্পী/সম্পাদনা: আশিক রহমান