প্রকৃতির বুকে মানবের সুখ
নিজেকে বড্ড ভালোবাসে মানুষ। চারদিকে যন্ত্রদানবের হুঙ্কার আর শব্দযাতনার জন্য মানুষ অনেক কিছুই শোনে না বা শুনতেও চায় না। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কখনো সচেতন বধিরতাও বরণ করে নেয়। একথা সত্য ‘অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ হবে না’।
শুনতে না চাইলেও বলতে এসেছি পাহাড়ের কথা। পাহাড় খুব কাঁদছে। কেউ তাদের কান্না শুনতে পায় না বা শুনতে চায় না। ১৯৯৬ সালের আগে পাহাড়ে রোপণ করা হয়েছিল এক বিষবৃক্ষ, তা একসময় মহীরুহে পরিণত হয়ে সহজজীবন করে দিয়েছিল কণ্টকময়। শুরু হলো পাহাড়ি-বাঙালির দ্বন্দ্ব। যারা ছিল প্রকৃতির সন্তান, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেতেই একসময় তারা হয়ে উঠল দুর্দান্ত শার্দুল। ১৯৯৬ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে উন্নয়ন কর্মকা- শুরু হয়। প্রকৃতির সন্তানেরা আশার আলো দেখতে শুরু করল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল পাহাড়। দুবাহু বাড়িয়ে দিল সমতলের দিকে। ভালোবাসতে চাইল স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের।
একদিকে চলছে উন্নয়ন কর্মকা- অন্যদিকে নতুন বসতি গড়ে তোলার নামে পাহাড় কাটা। প্রকৃতি যখন দেয় দুহাত উজার করেই দেয়। কিন্তু মানবের নির্যাতনে অতীষ্ঠ হলে চরম শাস্তির ব্যবস্থাও করে। ফলাফল পাহাড় ধসের ঘটনা। প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নেয় তখন তা হয়ে ওঠে ভয়াবহ ও প্রলয়ংকরী। যথেচ্ছ পাহাড় কেটে বাড়িঘর নির্মাণ এবং বড় বড় গাছ কেটে ফেলার ফলে পাহাড়ের কাঠামোগত সংকটের সৃষ্টি হয়। মাটির বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে সামান্য বৃষ্টিতেও পাহাড় ধসে পড়ে।
আজকাল আর বন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বন্যপ্রাণী দেখতে যেতে হয় চিড়িয়াখানায়। প্রকৃতিকে করা হচ্ছে মানুষের হাতের ক্রীড়ানক। আজ আর বুড়িগঙ্গাকে নদী বলা যাচ্ছে না। সে তার ঐতিহ্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কলঙ্কিত জনপদে। তাকে দেখলেই মনে হয় রাস্তার পাশে বসে থাকা এলোমেলো সেই পাগলীটা।মানুষের লালসার হাত শুধু নদী বা পাহাড়ে নয়, প্রকৃতির সব জায়গাতেই পড়েছে। আজ আর কোনো নদীকে কুমারীরূপে খুঁজে পাওয়া যায় না। পূর্ণ যৌবনা নদীরা তাদের সম্ভ্রম হারিয়ে কখনো পতিতাপল্লীর বৃদ্ধা পতিতার মতো ঘোলা চোখে চেয়ে আছে আবার কখনো মানুষের দেওয়া ফাঁস গলায় নিয়ে মাঝপথে থমকে আছে। কী করুণ মিনতি নিয়ে প্রকৃতি বলছে, ‘রূপ রস গন্ধসুধা দিয়ে বড় করে তোলা সন্তানেরা আমাকে বিধবার বেশে সাজিয়ে দিচ্ছে’।
এর কোনো জবাব নেই কারও কাছে। আছে কিছু কর্মপ্রচেষ্টা। চাইলেই প্রকৃতির পরিচর্যা করা যায়, তাও সামান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে। একটা গাছ কাটার আগে আরও দুটো গাছ লাগানো যেতে পারে। নদীর গতি রুদ্ধ হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা যেতে পারে।
তবে সবার আগে পাহাড়ের সহজ সরল মানুষগুলোর জীবন তাদের মতো করে যাপন করতে দিতে হবে। থাকুক না তারা তাদের মতো। পাহাড়ি জীবন তো আমাদের ঐতিহ্য। এটা আমরা আমাদের অহংকার হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। তাছাড়া দেশের একটা অংশ তো থাকতেই পারে আদিবাসী মানুষের পরিক্রমণের জন্য।এ ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে যা করা যায় তা কিন্তু যথেষ্ট নয়। এদেশের নাগরিকদেরও ভাবতে হবে প্রকৃতিকে যেমন আছে তেমন রাখার বিষয়টি। প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে এই আকাক্সক্ষাটা ধারণ করতে পারলেই মানুষ প্রকৃতির বুকে প্রকৃতির সন্তান হয়ে সগৌরবে জীবনধারণ করতে হবে। প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির বুকে একটা সুখের জীবন গড়ে তোলার ইচ্ছেই মানুষকে সাহায্য করতে পারে ভালো থাকতে। সময় এসেছে ফিরে দেখার, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার, প্রজন্মের জীবন কণ্টকমুক্ত করার।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান