এত রিজার্ভ থাকতে চালের দর আকাশচুম্বী হয় কীভাবে
ড. সা’দত হুসাইন
পৃথিবীর সবদেশ চাল উৎপাদন করে না। কোনো কোনো দেশ নগণ্য পরিমাণ চাল উৎপাদন করে, যা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না। এসব দেশ চাল আমদানি করে তাদের প্রয়োজন মেটায়। আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছেÑ সিঙ্গাপুর, হংকং, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান এবং অন্যান্য অনেক দেশ। হজের সময় সৌদি আরবে ত্রিশ লাখের মতো বহিরাগত হাজীর আগমন ঘটে। তারা গড়ে প্রায় তিন সপ্তাহ থেকে একমাস মক্কা-মদিনায় অবস্থান করে। তাদের খাওয়ার জন্য বাড়তি চাল আমদানি করতে হয়। আটা-ময়দা, তেল-ডাল, ফল-মূলসহ অন্যান্য খাদ্য সম্ভারও বিপুল পরিমাণে আমদানি করা হয়। অন্যান্য ছোট-খাট অসুবিধা যাই হোক না কেন, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের ব্যাপারে হাজীদের বা স্থানীয় লোকদের কোনো অসুবিধার কথা আমরা শুনিনি।
উন্মুক্ত বাণিজ্য (ঙঢ়বহ ঞৎধফব) ব্যবস্থায় কোনো দেশকে তার প্রয়োজনের সব পণ্য উৎপাদন করতে হয় না। যেসব পণ্য উৎপাদনে তার বিশেষ সুবিধা (ঈড়সঢ়ধৎধঃরাব অফাধহঃধমব) রয়েছে সেসব পণ্যই ওই দেশ উৎপাদন করে। বাকি পণ্য সেই দেশ আমদানি করে তার প্রয়োজন মেটায়। এক্ষেত্রে আমদানিকারক দেশের জন্য যা অত্যাবশ্যকীয় তা হচ্ছেÑ বৈদেশিক (আন্তর্জাতিক) মুদ্রার রিজার্ভ। ভা-ারে পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক তথা বৈদেশিক মুদ্রা থাকলে চিন্তার কোনো কারণ নাই। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভার দেশে নিয়ে আসবে। নাগরিকরা আন্তর্জাতিক বাজার দরে তা কিনতে পারবে। অবশ্য শুল্ক আরোপিত হলে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের চাইতে একটু বেশি হবে। যে দেশে সন্তোষজনক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে সে দেশের খাদ্যসামগ্রী বা প্রয়োজনীয় পণ্যের অভাব ঘটার কারণ নাই। সরবরাহ সংকট বা পণ্যমূল্যের আকাশ-ছোঁয়া দর সে দেশের জনগণকে অস্থির করে তোলে না।
সংবিধানে যাই থাকুক না কেন, বাংলাদেশ মুক্ত বাজার অর্থনীতির পথ অনুসরণ করছে। এই ব্যবস্থার পরিপূরক ধারা হিসেবে সোৎসাহে মুক্ত বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। আমদানি করছে, রপ্তানি করছে অনেকটা অবারিতভাবে। নিষিদ্ধ তালিকা আকারে তেমন বড় নয়, খাদ্যসামগ্রী আমদানিতে অশুল্ক বাধাও বড় একটা নাই। তবে শুল্ক আরোপিত রয়েছে, যা মুক্ত আমদানির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এমন ব্যবস্থায় দেশে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ কম থাকলে বিদেশ থেকে আমদানি করে সরবরাহ ঘাটতি অচিরেই মেটানো সম্ভব। এখানে সীমান্তের দর (ইড়ৎফবৎ চৎরপব) খুব প্রাসঙ্গিক। ‘বর্ডার প্রাইস’ বা আন্তর্জাতিক বাজার দর যদি কম থাকে বা এমনকি সমান থাকে তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে খরচ করে পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ সংকট দূর করা যায়। ‘বর্ডার প্রাইস’ কম হলে বাড়তি আমদানির মাধ্যমে বাজার দরও উল্লেখযোগ্যভাবে নিচে নামিয়ে আনা যায়। এক্ষেত্রে স্থানীয় আড়ৎদার, মজুতদার বা ব্যবসায়ীরা কারসাজির মাধ্যমে খাদ্যশস্যের দাম কোনোভাবে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগৃহীত পণ্যের দাম দেশীয় বাজারে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের হাতে রয়েছে মোক্ষম অস্ত্র: আমদানি শুল্ক। একমাত্র সরকারই আমদানি শুল্কের হার নির্ধারণ করতে পারে। এটি সরকারের একচেটিয়া অধিকার। যে পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর সুযোগ রয়েছে সে পণ্যের আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হলে দেশীয় বাজারে তার দাম কমে আসবে। প্রয়োজন শেষে সরকার আবার শুল্ক বাড়াতে পারবে। পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য আমদানি শুল্ক কমিয়ে বে-সরকারি আমদানিকারকগণকে পণ্য আমদানিতে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করলে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্য আমদানি করে বাজারে পণ্যের আকাল দূর করবে। একই সাথে সরকারও নিজস্ব চ্যানেলে খাদ্যশস্য আমদানি করে গুদামে খাদ্য মজুতদের পরিমাণ সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে, যা সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার (চঋউঝ) মাধ্যমে উদ্দিষ্ট (ঞধৎমবঃবফ) জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বা ন্যায্য দামে বিতরণ করতে পারে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে অচিরেই বাজারে খাদ্যশস্যের দাম কমে আসবে।
দেশে যেহেতু বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে, তাই সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে কয়েক মাস আগেই পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল আমদানি করার ব্যবস্থা করতে পারত। খাদ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথাপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। হতে পারে সরকারপ্রধানকে তারা যথাসময়ে যথাগুরুত্ব সহকারে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেনি। ফলে দেশে চালের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। সিন্ডিকেটবাজদের পোয়াবারো হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক থাকলে এমন অস্থির অস্বস্তিকর অবস্থা সহজেই এড়ানো যেত। এই সংকট থেকে ভবিষ্যতের জন্য আমরা এ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি যে, খাদ্য সংকটের আভাস পাওয়া মাত্র রিজার্ভের এক ক্ষুদ্র অংশ ব্যয় করে এবং আমদানি শুল্ক কমিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল-গম আমদানি করে বাজারে সরবরাহ ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব। চালের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি