উইম্যান চ্যাপ্টার ও বিবেচনা বোধ
‘উইম্যান চ্যাপ্টারে’র সম্পাদক সুপ্রীতি ধরের একটি লেখা নিয়ে প্রচুর বিরূপ সমালোচনা হচ্ছে। ‘ফেসবুকে’র কল্যাণে এখন কোনোকিছুই দৃষ্টির বাইরে যাবার যো নেই। ‘গৃহকর্মীরা যখন গৃহকত্রী হতে চায়’ শিরোনামের লেখাটি এত সমালোচনার কারণেই পড়লাম। কিন্তু সমালোচনার তুলনায় ভেতরে তো আহামরি কিছু নেই। আছে কিছু ‘অশ্লীলতা’, আর সাধারণ আলোচনা, এর বাইরে এত সমালোচিত হবার মতোন লেখা এটি নয়।
এমন লেখা নিয়ে ‘শ্রেণি সংঘাত’ জাতীয় বহু রচনা পড়লাম। নানা তত্ত্ব বিশ্লেষণ, পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কথামালায় সাজানো এসব রচনা। এসবের মধ্যে সার কিছুই নেই, শুধুমাত্র ‘বিরোধিতা’ উদগীরণ ছাড়া। এটা হলো চিরাচরিত কৌশল, ‘অন্যের বিরোধিতার মাধ্যমে নিজের পা-িত্য ফলানো, নিজেকে জাহির করা’ আর কিছু নয়। এ ধরনের লেখা এখন বড় ‘কমন’ হয়ে গেছে। নিজের পছন্দের বাইরের লোকজনের বিরুদ্ধে একশ্রেণির মানুষ এখন এই ‘কমন’ বাক্যবাণ ব্যবহার করছেন, একই শব্দচয়ন করছেন। সে হোক সুপ্রীতি ধর কিংবা ফরহাদ মজহার।
সুপ্রীতি ধরের লেখাটি যে চিন্তাকে রিপ্রেজেন্ট করতে চাচ্ছে তা তো পুরানো কোনো চিন্তা নয়। এখানে শ্রেণি সংঘাত, বৈষম্য বা বুর্জোয়া জাতীয় বাম চিন্তারও জায়গা নেই। তিনি শুধুমাত্র দোষগুণের সরলিকরণ করতে চেয়েছেন। মানুষ হিসেবে গৃহকত্রীদেরও দোষ রয়েছে, রয়েছে গৃহকর্মীদেরও, এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন সুপ্রীতি ধর। যারা সমালোচনা করছেন তাদের সমগোত্রীয় এক শিল্পী দম্পতির বাড়িতেও গৃহকর্মীর আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। সে সময় তাদের নিন্দাবাদ জানাতেও দেখা যায়নি। না এটা কোনো ‘ব্লেইম’ নয়, সরল প্রশ্ন। এটা মানব চরিত্রকে বোঝার জন্য একটি ছোট্ট ‘কুইজ’।
আমি যখন লিখছি তখন গণমাধ্যমে দেখলাম, একটি বাচ্চা মেয়ের পিঠ ঝলসে দিয়েছে এক গৃহকত্রী। ছবিতে দশ বছরের আমেনার বীভৎস পিঠ দেখে চমকে উঠলাম। ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায় মগজ ধেয়ে উঠে আসল ক্রোধ, কিন্তু ক্রোধ কোনো কাজের কথা নয়। কারণ আফরোজা নামের যে গৃহকত্রী মেয়েটির এ অবস্থা করেছে সে সমাজের সাম্প্রতিক উচ্চমধ্যবিত্তদের একটি অংশ, বলতে পারেন মধ্যবিত্ত সমাজেরই একজন। মেয়েটির অবস্থা দেখে মিজানুর রহমান নামের আরেকজন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে, এই মিজানুর রহমানও মধ্যবিত্ত সমাজেরই এবং সেও একজন গৃহকর্তা। এখানে একজন অত্যাচারী ও একজন রক্ষাকর্তা, দুজনেই একই সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী। সুতরাং ক্রোধ নয়, এখানে জাস্টিফাই করা উচিত বিবেচনা দিয়ে।
গৃহকর্তা আর গৃহকত্রীর দোষ যারা আড়াল করতে চান তারাও যেমন ভুল করেন, গৃহকর্মীদেরও দোষও সামনে না আনাটাও একই রকম ভুল। এখানেও হয়তো কেউ বুর্জোয়া মানসিকতা, শ্রেণি সংঘাত, অবস্থানগত দ্বন্দ্ব এসব তুলে আনতে চাইবেন। আনুন অসুবিধা নেই। আপনি আপনার চোখে দেখবেন, আমি আমার চোখে। তবে যাই দেখুন গৃহকত্রী বা গৃহকর্মী দুজনই কিন্তু মনুষ্য প্রজাতির। সাম্যবাদের দৃষ্টিতে দেখুন; দেখবেন, অনেক গৃহকর্মীর কারণে খুন হয়েছে গৃহের মালিক, অজ্ঞান করে বাসার জিনিসপত্র নিয়ে লোপাট হয়েছে, বাচ্চাটিকে অহপরণের সহযোগিতা বা অপহরণ করেছে গৃহকর্মী। অন্য বিষয়গুলোর বর্ণনা তো সুপ্রীতি ধর দিয়েছেনই। সুতরাং এই দোষগুলো আড়াল করলে, সামাজিক নিরাপত্তা বিঘিœত হবে নিজেদেরই। এখানে শ্রেণি সংঘাত আর বুর্জোয়া শ্রেণির কোনো ব্যাপার নেই।
অনেকে লিখেছেন, গৃহকর্মী রাখার প্রয়োজন কী, নিজেরা ‘বাচ্চাকাচ্চা’ সামলাতে পারবেন না জন্ম দেওয়ার কী প্রয়োজন, এমন কথা। অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন গৃহকর্মীদের ‘মজুরি’ বা বেতন নিয়ে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে ‘বুর্জোয়া’ দেশগুলোর তুলনা দিয়ে বলেছেন, ওখানে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে গৃহকর্মীর বেতন বেশি। অনেকে ‘বাচ্চাকাচ্চা’ ‘ডে কেয়ারে’ রাখার কথা বলেছেন। ‘কর্ম’ শব্দটি থেকেই উৎপত্তি ‘কর্মসংস্থানে’র। কর্মের প্রয়োজনেই সংস্থান। যারা ‘ডে কেয়ার’ বা ‘বেতন’ নিয়ে কথা বলছেন তারা আসলে রয়েছেন এক ধরনের ফ্যান্টাসির মধ্যে। আমি যাকে বলি ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আপনি কিভাবে একজন গৃহকর্মীকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে বেশি ‘মজুরি’ দিবেন, যেখানে অনেক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারই বেকার! আপনি যদি নিজে কোনো চাকরি করে থাকেন, তাহলে দেখবেন আপনার নিজের ভেতরেই ক্ষোভ রয়েছ ‘মজুরি’র ব্যাপারে। তা না হলে বেশি বেতনের আশায় কেউ বিদেশে ছুটত না। এমন প্রেক্ষিতে বাস্তবতা ভেবে কথা বলা উচিত। দেশে বেকার কতজন, গ্রামে কত মেয়ে না খেয়ে, না পড়ে আছে, এমন পরিসংখ্যান যারা ‘সমালোচনা’ কিংবা ‘আলোচনা’ করেন তাদের কাছে কী আছে? নেই। থাকলে এমন কথা বলতেন না। যদি দেশে গার্মেন্টস শিল্প বিকশিত না হতো, তাহলে দেশে যে পরিমাণ উচ্চ বা মধ্যবিত্ত রয়েছে তাদের বাড়িতে শুধুমাত্র খাওয়াপড়ার ভিত্তিতে গৃহকর্মীর অভাব হতো না। এখানে ‘বুর্জোয়া’ বিষয়ক কিছু নেই, এটাই রিয়েলিটি, প্রকৃত বাস্তবতা, ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’ নয়। আর ‘ডে কেয়ারে’ যারা বাচ্চা সামলাবেন তারা তো ‘কর্মী’ই, ‘গৃহে’র নয় ‘ডে কেয়ারে’র। কথা একটাই বাসাতেও বাচ্চা সামলানো এখানেও তাই। প্রতিটি দেশের, সমাজের কিছু নিজস্ব বাস্তবতা থাকে, নিজস্ব সিনারিও থাকে যা অস্বীকার করলে সমাধানও অস্বীকৃত হবে। ‘রিয়েলিটি’কে ‘রিয়েলিটি’ দিয়েই রুখতে হবে, ‘ম্যাজিক রিয়েলিটি’ দিয়ে নয়, এ কথাটি যত দ্রুত মানুষ বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল।
পুনশ্চ: কেউ যদি মনে করেন সুপ্রীতি ধরের কর্মকে জাস্টিফাই করার জন্য আমার এই লেখা তাহলে ভুল করবেন। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি চিনি না, প্রয়োজনও হয়নি। কিন্তু একজনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করি, সেই মতের সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু তা যুক্তির মাধ্যমে, তর্কের মাধ্যমে নয়, কূটতর্কেতো অবশ্যই নয়। সুপ্রীতি ধর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে তার চিন্তার সাথে আমার চিন্তার যোজন যোজন ফাঁরাক। কিন্তু তাই বলে একজন তার চিন্তার শেয়ার করতে পারবে না, সেটা তো হতে পারে না, তার চিন্তাকে কূটতর্কের নির্মমতায় পিষে দিতে হবে কেন? যেমন হয়েছে ফরহাদ মজহারের বেলায়, তার গুষ্ঠি উদ্ধার করা শেষে ফিরে আসার প্রার্থনা করা। সত্যিই আজিব কারবার!
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান