চিকিৎসকের পরিচয় এবং দেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট
ডা. জাকির হোসেন
চিকিৎসক হলেন এক ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদায়ক, যাদের পেশা হলো শারীরিক বা মানসিক রোগ, আঘাত বা বিকারের নিরীক্ষণ, নির্ণয় ও নিরাময়ের দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্য বজায় রাখা বা পুনর্বহাল করা। ল্যাটিন ভাষায় মেডিকাস শব্দ থেকে চিকিৎসক শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, যার বাংলা অর্থ ‘যিনি আরোগ্য লাভে সক্ষম বা যিনি যতœ নেন। উড়পঃড়ৎ শব্দটিও ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে যার বাংলা অর্থ হলোÑ শিক্ষক। চিকিৎসক হওয়ার জন্য শিক্ষালাভের কতগুলো স্তর আছে। আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় চিকিৎসক হওয়ার আশায়। আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে যেভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে চিকিৎসাবিজ্ঞানে জ্ঞানের প্রসারণ হচ্ছে না। একপ্রকার জড় জ্ঞানের মতো করে শিক্ষা দিয়ে চিকিৎসক তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান হলো একটি ডায়নামিক (উুহধসরপ) বিষয়।
বহু বৈচিত্র্যময়তার মানবদেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম তথা স্বাস্থ্য যে চিরকাল একই থাকবে তা কিন্তু কেউই বলতে পারে না। অস্বাভাবিক কার্যক্রম তথা একই রোগের ধরনও বহুভাবে প্রকাশ পেতে পারে। সবচেয়ে বড় ব্যপার হলোÑ চিকিৎসাবিদ্যার বইগুলো সব দেশের বাইরের লেখকেরা লিখেছেন। তারা সবাই তাদের দেশের মানুষের শারীরিকগঠন, তাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, তাদের পরিবেশের উপর ভিত্তি করে বইগুলো লিখেছেন। বর্তমানে সারাবিশ্বেই কম-বেশি পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। একই সঙ্গে এই দূষণের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগ বালইয়ের সংখ্যাও। আমাদের দেশে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে এই দূষণের মাত্রা অন্যান্য দেশ থেকে বহুগুণে বেশি। যার ফলে খুব দ্রুই পরিতর্ন হচ্ছে রোগের ধরন। কিন্তু এই পরিবর্তনের বিষয়গুলো আমাদের মেডিকেল শিক্ষায় একেবারেই প্রাধান্য পাচ্ছে না। যেন তেন করে মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে চিকিৎসক তৈরি করা হচ্ছে।
¯্রষ্টার অমোঘ নিয়ম ও ধ্রুব সত্য জন্মিলেই মরিতে হইবে। একজন চিকিৎসক কিছু রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারেন, নিরাময় করতে পারেন কিংবা মৃত্যুকে আরামদায়ক করতে পারেন। চিরজীবী করার ক্ষমতা কোনো চিকিৎসকের নেই। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের যারা ধারক ও বাহক হবেন, তাদের পেশার প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও সময় সচেতন হওয়া বাঞ্চনীয়। কারণ একজন চিকিৎসক চিকিৎসাবিদ্যায় তার সহজাত দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় রোগীর কাছে দিয়ে থাকেন। পরিতাপের বিষয় হলোÑ চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রাথমিক স্তরের জড় শিক্ষালাভের পর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গিয়েও কোনো চিকিৎসক এই জড় শিক্ষা থেকে নিজেকে বের করতে পারছে না। একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক নিজেও তার জড় চিকিৎসা জ্ঞানের ব্যাপারে অজ্ঞ। কারণ আমাদের চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানকে শাণিত করার কোনো পন্থা নেই। বলা যায় শিক্ষার্থীর কথা বলার স্বাধীনতাটুকু হরণ করা হয়। এই সেকেলে চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার ব্যর্থতার পেছনে যেমন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের অজ্ঞতা দায়ী তদুপরি দায়ী অভিজ্ঞ সৎ মানসিকতার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও শিক্ষকের চরম সংকট। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশেষায়িত চিকিৎসা শিক্ষায়ও দুর্বৃত্তায়ন ছড়িয়ে পড়ার কারণে এই বৃত্ত থেকে অনেকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে বের করতে পারেন না। মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার এই জড়তার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নন মেডিকেল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এই জটিলতার জন্য নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে গুণী চিকিৎসকেরা যেতে পারছে না, তাদের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাকে শিক্ষাগ্রহণ করার বিভিন্ন স্তরে লিপিবদ্ধ করতে পারছেন না।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান