মানসিকতার পরিবর্তন চাই
বস্ত্র মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহের একটি অন্যতম চাহিদা। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যে বস্ত্র পরিধান করে তা দেশেই উৎপন্ন হয়। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিশেষত উভয় শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে উৎপাদিত পোশাক শাড়ি ও সেলোয়ার কামিজের প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। উভয় শ্রেণির মহিলাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গৃহঅভ্যন্তরে ও বহিরাঙ্গণে ভারতে উৎপাদিত পোশাক পরিধান করে স্বস্তিবোধ করে। আমাদের দেশের মানুষজন স্ব স্ব ধর্মীয় উৎসবে নতুন কাপড় পরিধান করে থাকে। মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় দেশে উৎপাদিত কাপড়ের চেয়ে ভারতে উৎপাদিত কাপড় ক্রয় ও পরিধানে তারা অধিক আগ্রহী।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন বিপণীবিতানে শাড়ি ও সেলোয়ার কমিজ বিক্রেতারা দেশে উৎপাদিত শাড়ি ও সেলোয়ার কামিজকেও ভারতীয় বলে চালিয়ে দিয়ে অধিক মুনাফা লাভের ফন্দি-ফিকিরে মত্ত। অনেক দোকানিকে গর্ব ভরে বলতে শোনা যায়, আমরা দেশীয় কাপড় বিক্রি করি না। আমাদের দেশে বর্তমানে ঢাকাস্থ মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় উন্নতমানের শাড়ি প্রস্তুত হয়। এ সকল শাড়ির কিছু কিছু ভারতীয় শাড়ির সমমানের এবং কিছু কিছু যেমন জামদানি ভারতীয় শাড়ি থেকে উন্নতমানের। কিন্তু জামদানি ব্যতীত আমাদের দেশের উন্নতমানের শাড়ির ক্ষেত্রে দোকানিরা মিথ্যার আশ্রয়ে ভারতীয় দাবি করে তাদের ক্রয়কৃত মূল্যের ৩ থেকে ৪ গুণ অধিক মূল্য হাকিয়ে থাকেন। এ সকল ক্ষেত্রে অসচেতন ক্রেতা সকল প্রায়শই ক্ষতি ও প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন। এমন কিছু দোকান রয়েছে যেগুলোতে নির্ধারিত মূল্যে শাড়ি কাপড় বিক্রি করা হয়। কিন্তু এগুলোতেও দর কষাকষি যে চলে না এ কথাটি বলা যাবে না। নির্ধারিত মূল্যের এ সকল দোকানে ক্রয়মূল্যের তিন-চারগুণ অধিক মূল্যকে নির্ধারিত মূল্য ধার্য করা হয়। নির্ধারিত মূল্যের এ সকল দোকান থেকে যেকোনো ক্রেতা শাড়ি কাপড় ক্রয় করলে তিনি যে আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন এ প্রশ্নে সচেতন ক্রেতাদের মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় নেই।
আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষজন বিয়ে-শাদির শাড়ি কাপড় ভারতের কলকাতা হতে কেনাকাটায় আগ্রহ পোষণ করে থাকেন। তাদের দাবি কলকাতা থেকে কেনাকাটা করলে পছন্দের ব্যাপকতায় ভিন্নতা পাওয়া যায়, যা ঢাকার বাজারে অনুপস্থিত। তাছাড়া মূল্যের ক্ষেত্রে ঢাকার যেকোনো দোকানের চেয়ে অর্ধেক বা তারও নি¤েœর মূল্যে ক্রয় করা যায়। এ সকল ক্রেতারা বিয়ে-শাদি ছাড়াও বাৎসরিক শাড়ি কাপড়ের চাহিদা ভারতের বাজার হতে মেটানোর নিমিত্ত বছরে একাধিকবার তথায় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে থাকেন।
অতীতে ভারতের ভিসা প্রাপ্তি কিছুটা জটিলতর ছিল। সম্প্রতি ভিসা প্রাপ্তি সহজীকরণের কারণে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি আকাশ ও স্থল পথে ভারতের কলকাতায় পাড়ি জমান। বর্তমানে একজন বাংলাদেশি সার্কভুক্ত যেকোনো দেশে ভ্রমণের সময় কোনো ধরনের ঘোষণা ব্যতিরেকে ৫ হাজার ডলার সঙ্গে রাখতে পারেন। সার্ক বহির্ভূত দেশের ক্ষেত্রে এটি ৭ হাজার ডলার। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তি সহজতর হওয়ার পেছনে মূল যে কারণ তা হলোÑ প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থের জোগান। এ সকল প্রবাসী শ্রমিক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রেখে চললেও দেশে ফেরার সময় তাদের শুল্ক কর্মকর্তা কর্তৃক নাজেহাল ও হয়রানির ঘটনা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে যদিও ভারত হতে তাদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা অপব্যবহার করে যারা তল্পিতল্পা বিধির ব্যত্যয়ে অতিরিক্ত মালামাল নিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন তাদেরকে কখনো শুল্ক কর্মকর্তাদের হয়রানির মুখে পড়তে হয় না। ঢাকার বিভিন্ন বিপণীবিতানের শাড়ি কাপড় দোকানিদের দাবি এ বছর ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে ভারতীয় ভিসা সহজীকরণের কারণে তারা যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন এ ধারা অব্যাহত থাকলে তাদের শাড়ি কাপড়ের ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে হবে। এ বিষয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ক্রেতা সকলের অভিমত দেশের শাড়ি কাপড় ব্যবসায়ীদের সীমাহীন লোভের বশবর্তী হয়ে অতিরিক্ত মুনাফা এবং দেশীয় শাড়ি কাপড়কে ভারতীয় বলে চালানোর প্রতারণার কারণেই আজ এ দেশে জনমানুষের একটি বড় অংশ ভারতমুখী। আমাদের শাড়ি কাপড় বিক্রেতারা দেশীয় শাড়ি কাপড়কে দেশে উৎপাদিত বলে বিক্রি করলে ক্রেতাদের মধ্যে যারা দেশপ্রেমিক তারা অধিকহারে শাড়ি কাপড় ক্রয়ে আগ্রহী হবে এবং কখনো বিদেশি শাড়ি কাপড় বিশেষত ভারতীয় শাড়ি কাপড় ক্রয়ে আগ্রহ দেখাবে না। এ বিষয়ে আমাদের শাড়ি কাপড় দোকানিদের দেশাত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে আচরণ করার কথা ছিল তাদের নিকট হতে আমাদের দেশের সাধারণ জনমানুষে কখনো সে আচরণ পায়নি।
আমাদের দেশের যেকোনো ব্যবসায়ীর মধ্যে অধিক মুনাফার বিষয়টি এমনভাবে জেকে বসেছে যে এটি বর্তমানে নেশায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতাটি ব্র্যাক পরিচালিক আড়ং এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আড়ং বিভিন্ন জেলা শহর হতে স্বল্পমূল্যে নি¤œমানের শাড়ি কাপড় ও পাঞ্জাবি ক্রয় করে ন্যূনতম ৩-৪ গুণ অধিক মূল্যে তা বিক্রি করছে। এ এনজিওটি দেশের সাধারণ জনমানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি আজ একজন ব্যক্তির পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে দেশের সাধারণ জনমানুষের গলা কেটে চলেছে।
যথমলফমীংএ কথাটি অনস্বীকার্য যে ঢাকার বাজারে ভারতীয় যে শাড়ি অত্যধিক মূল্যে বিক্রি করা হয় তা ভারতের বাজার হতে অতি কম মূল্যে এ দেশের ক্রেতা সাধারণ ক্রয় করতে পারে। মূল্যের এ যে ফারাক এর পেছনে রয়েছে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের অতি লোভের কারণে অধিক মূল্যে বিক্রয়ের মনোবৃত্তি এবং প্রতারণামূলকভাবে স্বল্পমূল্যের দেশীয় শাড়ি কাপড়কে ভারতীয় বলে চালানোর ফিকিরফন্দি। এতে যে আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যহত হয়ে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্তত এ উপলব্ধি হতে ভারতীয় শাড়ি কাপড়ের প্রতি আসক্তির মানসিকতার পরিবর্তন হোক এটাই এখন এ দেশের সাধারণ জনমানুষের চাওয়া।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান