ধর্ষণ কি বায়োলজিক্যাল, নাকি কিছু সংস্কারের ফল? ঠঅঢ
ডা. মো. তাজুল ইসলাম
ধর্ষণ কোনো যৌন বিষয়ক সমস্যা নয়, এটি একান্তই নারীর প্রতি সহিংসতা ও অপরাধ বিষয়ক ঘটনা। ধর্ষণ নির্যাতিতা নারীর জীবনে এক চরম বেদনাদায়ক এবং অপমান ও গ্লানির ঘটনা। এটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগের অন্যতম একটি, যে স্মৃতির যন্ত্রণা তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। একজন নারীর বুনিয়াদী সত্তাকে এটি ভেঙে-চুরে দেয়। সমাজের কাছে সে ও তার পরিবার কি নিগ্রহের মধ্যে পড়ে তা একমাত্র ওই নির্যাতিতা ও তার পরিবার জানে। কোথায় সহমর্মি হয়ে তাদের দুর্ভোগ ও কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করব, না উল্টো তাদের গভীর আবেগীয় ক্ষতে ‘অপবাদ, দুর্ণামের লবণ ছিটিয়ে’ দিয়ে তাদের ক্ষত আরও গভীর করে তুলছি। অথচ ইসলাম ধর্মেও ধর্ষণের শাস্তি পাথর মেরে হত্যা করার কথা বলা আছে।
কিছু পুরুষ ও ধর্ষিত হয় বটে তবে নারীরাই ধর্ষণের প্রধান শিকার। অথচ যৌন কামনা-বাসনা নারী-পুরুষ উভয়ের সমান। তাহলে নারী নিজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও পুরুষ কেন পারে না? এ না পারা কোনো বায়োলজিক্যাল ব্যাপার নয়, এটি সমাজ-সংস্কৃতির কাঠামোর গভীরে প্রোথিত কিছু সংস্কার, মিথ ও বিশ্বাসের ফল। আমাদের কয়েক হাজার বছর লেগেছে ‘দাসত্ব প্রথা’ উচ্ছেদ করতে, কয়েক হাজার বছর লেগেছে ‘বর্ণবাদ’ উৎখাত করতে (যদিও অনেক ফর্মে এদের কালো ছায়া এখনো বিদ্যমান)। কিন্তু নর-নারীর সমতা বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি গত কয়েক শতকের মাত্র। এ অগ্রগতির কিছু দিক তাৎপর্যপূর্ণ হলেও কিছু দিকের অগ্রগতি নিতান্তই হতাশাজনক। তার অন্যতম একটি হলোÑ নারীর ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিতির স্বীকৃতি। পুরুষের কাছে নারীর এখনো মুখ্য পরিচয় ‘বিনোদন সঙ্গী, কাম সঙ্গী’ হিসেবে। শিক্ষিত, সুশীল পুরুষরা বাহ্যিকভাবে নারীর প্রতি তাদের কাম ভাবনাকে সফিস্টিফিকেসনের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করে, তবে দানব প্রকৃতির পুরুষ সরাসরি হামলে পড়ে- এ হচ্ছে পার্থক্য। নারীকে যৌনতার বাইরে রেখে পূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখার সাংস্কৃতিক চেতনার বিনির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত কিছু পুরুষের কামনার দ্বারা নারীর ধর্ষিতা হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
শ্রেণি বিভাগ: এক. পরিস্থিতি অনুযায়ী: অভিসার/দাওয়াত ধর্ষণ, (বনানীর ধর্ষণ), শিশু ধর্ষণ (৫ মাসের মেয়েকে যোনি কেটে বড় করে ধর্ষণের খবর কিছুদিন আগের খবর মাত্র), জেলখানায় ধর্ষণ, পরিচিতজন দ্বারা ধর্ষণ (বেশিরভাগ ধর্ষণ এ পর্যায়ের), সম্মতি দেওয়ার বয়স হয়নি তেমন বালিকা ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, দাম্পত্য ধর্ষণ, নিকটাত্মীয় দ্বারা ধর্ষণ (আপন পিতা নিজ কন্যাকে আটকে রেখে বহু বছর ধর্ষণের কথা পত্রিকায় এসেছে)- ইত্যাদি। দুই. ধর্ষকের লক্ষ্য অনুযায়ী: ক. ক্রুদ্ধ ধর্ষক: এদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্যাতিতাকে অপদস্ত, অপমান করা, তার চরিত্র নষ্ট করা। এরা ধর্ষিতাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে থাকে। এরা তাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়, মারধর করে, কাপড়-চোপড় ছিড়ে ফেলে। এরা নারীকে কাবু করতে যতটুকু শক্তি প্রয়োগ দরকার তার চেয়ে বেশি শক্তি খাটায়। খ. ক্ষমতা দেখানো ধর্ষক: এদের নিজের সামর্থ্য, সক্ষমতা সমন্ধে থাকে নেতিবাচক ধারণা। এই মানসিক ঘাটতি পূরণ করতে তারা নিজেদের কর্তৃৃত্ব, শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা দেখাতে ধর্ষণ করে থাকে। এরা মৌখিকভাবে হুমকি দিয়ে, অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করে থাকে। তবে এ শক্তি প্রযোগ হয় শিকারকে বাগে আনতে যতটুকু লাগে ততটুকু।
তারা ধর্ষণ নিয়ে ফ্যান্টাসিতে মত্ত থাকে ও নিজকে বিজয়ী হিসেবে দেখে। তারা বিশ্বাস করে প্রথমদিকে মেয়েরা বাধা দেবে, তবে একবার পরাস্ত করতে পারলে ওরা এটি উপভোগ করবে। এ বিশ্বাসের কারণে অপকর্ম করার পরও তারা ওই মেয়েদের আবার ডাকলে আসার আহ্বান করে। কিন্তু তাদের অপর্যাপ্তবোধ এর অবসান হয় না। তাই তারা নিত্যনতুন শিকার খুঁজতে থাকে এবং এটি তাদের জন্য ‘বাধ্যতামূলক’ হয়ে দাঁড়ায় (বেশিরভাগ ধর্ষক এই ক্ষমতা দেখানো টাইপের) গ. পীড়নকারী ধর্ষক: যৌন সঙ্গিনীকে নিপীড়ন করে, যন্ত্রণা দিয়ে এরা উত্তেজনা অনুভব করে। এরা তৃপ্তি পেতে ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখে টর্চার করে। বিশেষ করে যৌনাঙ্গগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে বিকৃত আনন্দ লাভ করে। এ রকম নির্যাতনে বেশিরভাগ ভিকটিম মারা যায়। এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
লেখক: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
সম্পাদনা: আশিক রহমান