রাজনৈতিক সদিচ্ছাই সংকট সমাধান করতে পারে : বিশেষজ্ঞ মত রাজধানীতে জলজট-যানজট
উম্মুল ওয়ারা সুইটি ও শাকিল আহমেদ : প্রকৃতিতে বর্ষা আসে আশীর্বাদ হয়ে। গ্রীষ্মের খরতাপের যখন সবকিছু চৌচির তখন সবাই অপেক্ষা করে কালো মেঘের ঘনঘটায় কখন বৃষ্টি ছুঁয়ে যাবে। আর ঢাকা মহানগরীর মানুষেরা এক পশলা বৃষ্টির জন্য একসময় প্রার্থনা করত। কারণ ঢাকায় তুলনামূলক বৃষ্টি কম হয়। এখন ঢাকাবাসীর জন্য সেই বৃষ্টি দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় ঢাকা।
যদিও ঢাকায় গত ১৫ বছর ধরেই কয়েক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায় এবং যানজট তৈরি হয়। তবে সেটি হয়তো বর্ষা মৌসুমের চার মাসে ১০ থেকে ১২ দিন। কিন্তু গত চার বছর ধরে নগরীতে ৪০ থেকে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই দুই তৃতীয়াংশ পানিতে ডুবে যায়। তারপরও নগরবাসী গরম থেকে রেহাই পেতে এবং একটু সতেজ হতে বৃষ্টি বন্দনা করতেন। কারণ দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই পানি নেমে যায়।
গত কয়েক বছর ধরে নগরবাসী আর বৃষ্টি বন্দনা করে না। শিশুরা বারান্দায়, স্কুল মাঠে এবং রাস্তায় বৃষ্টি মেখে খেলা করবে এটা আর কেউ চায় না। বৃষ্টি এলো বলে যে উচ্ছ্বাস নগরবাসীর ছিল তা এখন বিষাক্ত হয়েছে। পবিত্র বর্ষা নামে নগরীতে অভিশাপ হয়ে। কারণ ঢাকা মহানগরীতে মাত্র ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই সব যেন থেমে যায়। ময়লা আবর্জনা আর স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে পানির লাইন মিলে কোমর সমান পানিতে ভাসতে থাকে মল, পলিথিন, ডাস্টবিনের ময়লা। পানিতে পূতিময় দুর্গন্ধ।
তার উপর রয়েছে, সড়ক উন্নয়ন (ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ) মূলক কাজের কারণে ফুটপাত থেকে রাস্তাগুলোর গর্ত, খানাখন্দ।
সরেজমিনে গত দুদিনের বৃষ্টিতে রাজধানীতে সৃষ্টি হওয়ার জলাবদ্ধতায় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, বিভিন্ন দুর্ভোগের চিত্র।
মঙ্গলবার ও বুধবারের বৃষ্টিতে মৌচাক ও মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর মোড়, সিদ্ধেশ্বরী রোডের শুরু থেকে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল পর্যন্ত সড়ক, আনারকলি মার্কেটের সামনে ঘোলা পানির ¯্রােত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেই জলাবদ্ধতা।
উড়ালসড়ক নির্মাণের কারণে শান্তিনগর মোড় থেকে মালিবাগ মোড় হয়ে পশ্চিমে মগবাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের পানি নিষ্কাশনের নর্দমা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি জমে যায় রাস্তায়। একই অবস্থা শাহবাগ, ফার্মগেট, সংসদ ভবন এলাকা, ধানমন্ডি, মিরপুর, রামপুরাসহ রাজধানীর এক তৃতীয়াংশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুদিনে স্কুল থেকে শুরু করে সচিবালয় কোথাও কেউ সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি। ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় লেগেছে। আর সেই সঙ্গে বেড়েছে ছোট-বড় অসংখ্য দুর্ঘটনা। ঢাকা যেন একেবারেই অচল বৃষ্টির কাছে।
এদিকে রাজধানীর দুই মেয়র জানেন না কবে নগরবাসী এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাবে। ঢাকা ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হাসিবুর রহমান বলেন, মালিবাগ-শান্তিনগর এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদের বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে কবে এর সমাধান হবে না এর ফলে আগের চেয়ে এখন এই এলাকায় কম জলাবদ্ধতা হচ্ছে। উড়ালসড়ক নির্মাণের কারণে নিষ্কাশনের নর্দমা তৈরির কাজ কোথাও কোথাও বন্ধ আছে। ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষ হলে নর্দমাগুলো তৈরি হবে। তখন এখানে আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন দেশের বাইরে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, শুধু সিটি করপোরেশনের পক্ষে এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য ওয়াসাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
অভিন্ন মত ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের। তিনি বলেন, খাল ভরাট করে ভবন হয়েছে, পানি যাবে কোথায়? তিনি বলেন, এর জন্য এক ধরনের বিপ্লব প্রয়োজন। ঢাকার খালগুলোর মধ্যে এখন দুইটাও বোধ হয় নেই। খাল ভরাট করে সেখানে চার-পাঁচতলা ভবন করা হয়েছে। আনিসুল হক বলেন, এর জন্য সিটি করপোরেশন কোনোভাবেই দায়ী না। খালের মালিক জেলা প্রশাসন, আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওয়াসার। তারা ২৫ বছরে এই খাল কী রক্ষণাবেক্ষণ করেছে, তার হিসাব দিক।
নগরবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নগরায়ণবিষয়ক সদস্যসচিব স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সব এলাকায় প্রচুর বহুতল ভবন, মার্কেট হয়েছে। এসব এলাকা থেকে পানি নামার কোনো ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টির পানির একটি বড় অংশ নদী বা খালে যায়, আরেকটি অংশ পুনর্ভরণ প্রক্রিয়ায় যায় ভূগর্ভে। নগরীর প্রায় সবকটি এলাকায় দুটি প্রক্রিয়াই ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, এর থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন প্রবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাসকিন এ খান বলেন, ঢাকায় কোনো জলাবদ্ধতা নেই। এটা জলজট। এই জলজট নিরসনের জন্য আমাদের যে কৃত্রিম ব্যবস্থা, তা যথেষ্ট উন্নত। কিন্তু একবারে বেশি বৃষ্টি হলে নিষ্কাশনে সময় বেশি লাগে। তিনি বলেন, খাল তো সবই আছে। ৬২টি খালের মধ্যে ২৬টি আছে। এর মধ্যে ১৩টি ডেভেলপ (উন্নয়ন) করা। বাকি ১৩টির উন্নয়ন চলছে। সম্পাদনা : হুমায়ুন কবির খোকন