অপরাধী, কারাগার এবং সমাজবাস্তবতা
বাংলাদেশের প্রতিটি কারাগারে লেখা থাকেÑ রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ। কিন্তু লেখার সঙ্গে কারাগারের জীবনযাপনের কোনো মিল ছিল না। ২০০৩ সালে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় সজল হত্যার আসামি হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে অবস্থান করতে হয়েছে। ঢাকা কোর্ট থেকে গারদখানায় ময়লা আবর্জনার বিশ্রী গন্ধে নাড়ি-ভুড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম হতো। প্রিজন ভ্যানে প্রচুর গরম ও গাদাগাদি করে একগাদা মানুষের অবস্থান। কারাগারের গেটে এক লাইনে অবস্থান, আমদানিতে অমানসিক আচরণ। সকালে রপ্তানি, চুলকাটা শেষ হলে কয়েদিরা নব-বন্দিদেরকে নিয়ে টানাটানি, কার ভাগে কে। সবকিছু শেষ হলে এবার টাকাপয়সার হিসাব কে কত খরচ করতে পারবেন, কতটুকু আরাম আয়েশে থাকবেন তা টাকা দেওয়ার উপর নির্ভর করে। কারাজীবন ছিল অমানসিক। আমার দাবা খেলার শখ ছিল, কারাগারে সাজা হওয়া একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দাবা খেলেছিলাম। এমন সময় একজন মিয়া সাব দাবার কোর্ট লাঠি মেরে ফেলে দিল, আমি চেয়ে আছি, মিয়া সাব আমার পূর্ব পরিচিত। আমি একসময় জেলখানার মাংস সাপ্লায়ার ছিলাম, মিয়া সাব লজ্জিত হয়ে কাছে বসলেন। কেমন আছেন, এখানে কি করে আসলেন ইত্যাদি প্রশ্ন ও কুশলাদি বিনিময় হলো।
একজন বন্দি যাতে কারাগার থেকে বেরিয়ে আর কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে, বন্দিজীবন কত ভয়ঙ্কর তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারে তা বুঝিয়ে দেওয়া। আমি বললাম, এখানে যাদেরকে দেখছ এর ৯০% নিরাপরাধ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার, যেমন আমি এখন হত্যা মামলার আসামি, যে কি না জীবনে একজন নিরাপরাধ মানুষকেও হেনস্থা করিনি, হত্যা করা তো অনেক দূরের কথা। মিয়া সাব বললেন, এ কথা আইন মানে না। আমাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে বলে মুখে ফেনা তোলার অনেক সংগঠন আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবাধিকার উন্নয়নে কাশিমপুর ও কেরানীগঞ্জে দুইটি বৃহৎ কারাগার নির্মাণ করেছেন। কয়েদি ও হাজতির জীবনযাপনের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, সশ্রম কারাদ-ে দ-িত আসামিদের কর্মের ব্যবস্থা হচ্ছে এবং আয়ের পথ করে দেওয়া হয়েছে। কারাগারে কর্ম করে সেই আয়ের টাকা সংসারে ছেলেমেয়ের জন্য পাঠাতে পারেন। শিশু অপরাধীদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে জীবন অঙ্কুরেই ঝরে না যায়। কাশিমপুর-২ কারাগারে স্থাপিত কারাবন্দি পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ স্কুলে বন্দিদের রেডিমেড গার্মেন্টস, ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রেস, বেকারি, পার্টিকেল বোর্ড, ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স, টেইলারিং, কাঠের ফার্নিচার, পাওয়ার লুম, হস্তশিল্প, প্লাস্টিক ফার্নিচার, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, ইলেকট্রিক পণ্য তৈরি নিয়ে মোট ১০টি ট্রেডের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই এসব প্রশিক্ষণের উপর কারিগরি বোর্ডের অনুমতির জন্য আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনাই পারে এবং পারবে কারাগারকে সংশোধনাগার করতে। মানুষ পৃথিবীতে অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না, সামাজিক অবক্ষয়, পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে অপরাধ জগতে পা বাড়াতে বাধ্য করে, অনেকাংশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অপরাধী হতে হয়। কিছু অপরাধী, অপরাধী হয় না আমি তা বলছি না। তবে সমাজের কাছ থেকে সহানুভূতি পেলে তারা অপরাধ জগতে যেতে চায় না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাজানো আসামি জজ মিয়া তার বড় প্রমাণ। সমাজের দায়িত্ববান ব্যক্তিরা যদি দায়িত্ব পালন করেন, তবে অপরাধীর সংখ্যা কমে আসতে বাধ্য। আমাদের রাষ্ট্রে অপরাধীর সংখ্যা কত তা আমার জানা নেই, তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাহিনীর কার্যক্রম ও সংশোধনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিশ্বের যেকোনো দেশের চাইতে অপ্রতুল বলা যাবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশÑ বাংলাদেশ। শত প্রতিকূলতার মাঝেও বর্তমান সরকার কারাগার উন্নয়নে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, তার প্রশংসা না করে পারছি না। মানুষ সংশোধন না হলে রাষ্ট্র সংশোধন হবে না, রাষ্ট্র সংশোধন না হলে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে পারব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মানবাধিকার নিয়ে ভাবনার বিষয় আমাদেরকে গর্বিত করে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
সম্পাদনা: আশিক রহমান