বন্ধ করো এই অনিশ্চিত যাত্রা
কর্মসংস্থান কিংবা উন্নত জীবন লাভের আশায় মরীচিকার পেছনে ছুটছে আমাদের অসংখ্য যুবক, কম খরচে বেশি লাভের আশায় নিজেদের লোভ সামলাতে না পেরে আরও বড় লোভীর খপ্পরে পড়ে শেষে মহামূল্যবান জীবনটাই শেষ হয়ে যায়। মিথ্যা প্রলোভনের স্বীকার হয়ে বেশি আয়ের জন্য, উন্নত জীবনের আশা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কত যে বাংলাদেশিরা কেবল প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হয়েছে তাই নয়, কতজনের যে জীবনাবসান হয়েছে তার কোনো সঠিক হিসাবও নেই। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ইরান, লেবানন ও জর্ডানে কর্মরত বাংলাদেশিদের মধ্যে তুরস্ক গমনের প্রবণতা বেড়েছে। এর পেছনে রয়েছে অবৈধ পস্থায় ইউরোপে প্রবেশের আকাক্সক্ষা। তুরস্কে সক্রিয় মানবপাচারকারী দলের প্রলোভনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাবার আশায় বাংলাদেশিরা যে ঝুঁকি নিচ্ছেন এটা মৃত্যুকূপ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ তুরস্ক হয়ে ইউরোপে পাড়ি দেওয়া প্রায় অসম্ভব ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও সব জেনে বুঝে অনেক বাংলাদেশি এ পথটাই বেছে নিচ্ছেন এবং সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সময় মারা পড়ছেন, যা খুবই দুঃখজনক।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের ভাষ্যমতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশে কমপক্ষে ৯৩ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছেন। দুঃশ্চিন্তার বিষয় হলো, শুধু ইউরোপ নয়, সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী দলের প্ররোচণায় মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধ পথে পাড়ি জমাতে গিয়ে অনেকেই ধরা পড়েছে এবং নানান রকমের বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন। অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে শুধু নিজেই হারিয়ে যাচ্ছেন না সঙ্গে গোটা পরিবারে বিপর্যয় ডেকে আনছেন। একই সঙ্গে দেশের বদনাম হচ্ছে, যা দেশ বা জাতির জন্য খুবই অশনি সংকেত। সর্বশেষ এক হিসাব বলছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে যারা ইউরোপের পথে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে, যাদের মধ্যে কদাচিৎ কেউ সফল হলেও প্রায় সবাই ব্যর্থ হয়; সেই তালিকায় বাংলাদেশিরা রয়েছে সবার শীর্ষে। মানবপাচারকারীরা বিভিন্ন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বোকা মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন রকম ফাঁদ পাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কম খরচে পাঠানোর কথা বলে। এরকম ফাঁদে পা দিতে গিয়ে ইতালি অভিমুখী বিপজ্জনক সেই যাত্রায় ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে সাগরে ডুবে যায় অন্তত ৮০০ মানুষ। আর বছর শেষে ভূ-মধ্যসাগরে ডুবে মারা যাওয়ার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার। আইওএমের ঢাকা দফতরের কর্মকর্তারা এক প্রতিবেদনে জানান, চার বছর ধরে প্রায় একই হারে বাংলাদেশের লোকজন ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। মানবপাচারকারীদের একটি চক্র এদেরকে শুরুতে ঢাকা থেকে কয়েক মাসের ভ্রমণ ভিসায় লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে সাগর পথে যায় ইতালিতে। কর্মসংস্থানের সন্ধানে বিদেশগামীদের অনেকেই নানাভাবে প্রতারণা বা হয়রানির শিকার হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে কেবল বিদেশ গমনেচ্ছুরাই সর্বস্বান্ত হচ্ছে না, এর ফলে দেশও অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতারকদের কারণে ইতোমধ্যেই বহির্বিশ্বের অনেক সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার হারাতে হয়েছে আমাদের। তারপরেও থেমে নেই এই প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। তাই দেশের বাইরের মানবপাচারকারী চক্রকে রুখে না দিতে পারলেও দেশের ভেতরের এই চক্রকে রোধ করা গেলে তা অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য যেমন স্বস্তিদায়ক হবে, তেমনি দেশের জন্যও হবে কল্যাণকর। যেকোনোভাবেই হোক অবৈধভাবে বিদেশ গমন রোধ করা না গেলে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়া বন্ধ হবে না। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর ভূমিকার পাশাপাশি জনসচেতনতারও প্রয়োজন রয়েছে। অবৈধভাবে বিদেশ গমন চেষ্টার বিপদ সম্পর্কে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে সরকার। মনে রাখতে হবে শুধু অবৈধভাবে বিদেশ গমন রোধ করলেই চলবে না, পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারেও মনোযোগ দিতে হবে। যুবশক্তির কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই জমিজমা বিক্রি করা বা ঋণ করা মানুষজনেরা যাতে তাদের কঠোর শ্রমের বিনিময়ে সঠিক মূল্য আদায় করে নিতে পারে, তেমন দক্ষ জনশক্তি যাতে দেশ রপ্তানি করতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দিবে সরকার সেই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: আশিক রহমান