আল মাহমুদকে কি মুক্তিযোদ্ধা কবি বলা যায়?
প্রসঙ্গ উঠেছিল হাসান মোরশেদের একটি পোস্টে শামসুর রাহমান গুরুত্বপূর্ণ কেন? এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে হাসান মোরশেদ এক জায়গায় লিখেছিলেন – রাহমানের সমালোচনা করে কেউ কেউ মনে করিয়ে দিতে ভুলেন না আল মাহমুদ কিন্তু অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমার কথার প্রসঙ্গে আরো মন্তব্য করেন – এমন ও প্রচার করা হয়, এই হুজুরই নাকি ‘একমাত্র কবি যিনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন, বাকি বদমাশগুলো কলকাতায় বসে মদ আর মাগীবাজী করেছে ।
আমি তখন বলি – এই বিষয়টি নিয়ে আমার কৌতুহল আছে । আজ পর্যন্ত কোথাও পেলাম না যে উনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন। যাই হোক, একটু সময় পেলে বিষয়টি ঘেটে দেখব । হাসান মোরশেদ খুঁচিয়ে দেন – ঘাঁটানো দরকার । কারো চরিত্রচিত্রণ আমার উদ্দেশ্য নয় । আল মাহমুদকে আমি খুবই শক্তিমান কবি হিসেবে মানি, তার রাজনৈতিক দুঃখজনক বিবর্তন সত্ত্বেও যে কয়জন কবি আমাদের সময়কে প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাদের মাঝে আল মাহমুদের নাম প্রথম সারিতেই রাখতে হবে । যদিও তার ইদানীংকার মোনাজাত জাতীয় কবিতা পাঠক হিসেবে আমার পছন্দের তালিকায় নেই, তার সাম্প্রতিক কবিতার বইটি আমি ফেলে দিয়েছি, তবু তার আগের লেখাগুলোর কারণেই তার অবস্থান আমার মনে অনেক উচ্চাসনে রয়েছে ।
আল মাহমুদের কাব্যবিচারের সাধ বা সাধ্য কোনোটাই আমার নেই । আমি শুধু তার মুগ্ধ পাঠক । কিন্তু জটিলতা সৃষ্টি হয় যখন তার রাজনৈতিক অবস্থানটি আলাদাভাবে আমাদের বিচার্য হয়ে ওঠে । সেই জায়গায় আল মাহমুদ আমার প্রতিপক্ষ দলে অবস্থান করেন ।
তাই যখন আমার প্রতিপক্ষ দল গর্বের সাথে বলে – দেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কবি তাদের শিবিরে অবস্থান করেন, তখন আমি হতাশ হয়ে পড়ি । শামসুর রাহমান কেন নিজের গ্রামে বসে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি ছদ্মনামে লিখে সেটা স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠিয়ে দায় সারলেন, তিনি কেন আল মাহমুদের মতো সশস্ত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন না, সেটা নিয়ে আফসোস করতে থাকি ।
কিন্তু বহুদিন ধরেই আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না আল মাহমুদ কোন্ সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন । হাসান মোরশেদের ‘ঘাটানো দরকার’ মন্তব্যটি আবার আমাকে খুঁচিয়ে তোলে ।
গত কয়দিন ধরে কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিলাম । কিন্তু কোথাও এই বিষয়ে কিছু পেলাম না ।
আজ এক কাজিনের বই আলমারিতে অন্য একটি বই খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেলাম স্বয়ং আলমাহমুদের আত্মজীবনী । বইটির নাম ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ । প্রকাশক : একুশে বাংলা ।
আসুন, সেখান থেকে কিছু অংশ পড়া যাক :
‘৭১ সালে ভারত পাড়ি দেয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে কবি জানাচ্ছেন :
‘’ আমার ভগ্নীপতি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি হোসেন তৌফিক ইমাম সেখান থেকে সপরিবারে আরগতালায় পৌঁছেছেন । …জেনে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম । এ পরিস্থিতিতে নারায়ণপুরে আমি নিরাপদ ছিলাম না । মনে মনে দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার একটা আকাক্সক্ষাও জেগে উঠেছিল ।’’
যাক, নানা বিপর্যয় পেরিয়ে আল মাহমুদ অবশেষে কলকাতা পৌঁছান ।
তিনি সেখানে তৌফিক ইমামের বাসাতেই আশ্রয় নেন ।
তবে মুক্ত পরিবেশেও কবিকে বেশি সাহসী বলে মনে হচ্ছে না, কারন তিনি বলছেন :
“এখানে এসে উডস্ট্রিট থেকে আমি একদম বেরুতাম না । কারণ অতি কৈশোরে আমার খানিকটা জানা থাকলেও ওই সময়ে তা আগের মতো থাকার কথা নয় । আমি ভয় পেতাম ঠিকমতো বাসায় এসে পৌঁছতে পারব না ।”
অর্থাৎ কবি আসলে নিজের বাসায় ফেরার ব্যাপারেই বেশি কাতর ছিলেন দেখা যাচ্ছে ।
যদিও পরের প্যারায় উনি জানাচ্ছেন :
“আমি নয়মাস কলকাতায় অবস্থানকালে আমার প্রধান নেশাই ছিল কলকাতাকে জানা । এ ব্যাপারে যারা আমাকে সাহায্য করেছিলেন কলকাতার ওপর বই লিখেছেন সেই পুর্ণেন্দু পত্রী এবং কবিতা সিংহের মেয়ে রাজেশ্বরী রায়চৌধুরী ।”
অর্থাৎ, কবি নয়মাস কলকাতাতেই ছিলেন এবং পূর্ণেন্দু পত্রী আর রাজেশ্বরী রায়ের সাথে কলকাতাকে জানতেই তার সময়টি ব্যয় হয়েছে । দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কলকাতাকে জানাটা যদি কবির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তাহলে তাকে আর যাই হোক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিয়ে ফেলাটা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয় ।
তারপর কবি বিভিন্ন বর্ণনায় জানাচ্ছেন, তাকে পেয়ে কলকাতার কবিকূল কেমন খুশি হয়েছিলেন । এই পর্যায়ে আমাদের গৌরবান্বিত হওয়ার অনেক তথ্যই আছে ।
কিন্তু যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত কথা ,সেখানে কবির ভুমিকা কী ?
“ততদিনে আমার ভগ্নীপতি প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন । আমি তখনো তার সঙ্গেই আছি । এর মধ্যে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল ।”
কী সেই দায়িত্ব, সেটা জানতে হলে পড়তে হবে পরের লাইনটি ।
“বিভিন্ন পত্রিকায় আমার সমর্থন একটু -আধটু সমর্থনসূচক প্রতিবেদন ছাপা হতে শুরু হয়েছে ।”
অর্থাৎ, কবি তখন আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়ে সেই পত্রিকার কাটিং জোগাড় করে চলছেন।
তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সাথে তার সংযুক্তি কোথায় ?
আছে এর পরের লাইনে ।
উনি জানাচ্ছেন ,
“তা ছাড়া আট নম্বর থিয়েটার রোডে মুক্তিযুদ্ধের মূল অফিসের স্টাফ হিসেবে আমার নাম থাকায় আমি একটি পরিচয়পত্র পেয়ে গেলাম । এটা ছিল আমার জন্য একান্ত জরুরি । কারণ তখন কলকাতায় চলাফেরা করার জন্য এই পরিচয়পত্রটি থাকা দরকার ছিল ।”
এই পরিচয়পত্রটি নিয়ে উনি কী করেছেন ?
“ আমাকে কেউ কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব না-দিলেও আমি কলকাতার লেখক, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মধ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন যোগানোর কাজ করে চলছিলাম ।”
কলকাতার লেখক, শিল্পী ও সাহিত্যিকগণ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কেউ ছিলেন বলে জানা যায়নি কোনোদিনই, তখনকার সময় বিবেচনা করলে ভারতবাসী কারো পক্ষেই এই বিরোধিতা করার কোনো কারণই নেই । তাছাড়া কোথাও সেই ধরনের মটিভেশনে আল মাহমুদ কিছু করেছেন বলে নিজেও দাবি করেননি, বরং বিভিন্ন জায়গায় কবি সাহিত্যিকদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর অনেক বর্ণনা আছে । সেগুলো নিছকই কবি সাহিত্যিকদের চিরন্তন আড্ডাবাজী, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিষয়ই নেই ।
শামসুর রাহমান যখন অবরুদ্ধ দেশে থেকেও ছদ্মনামে স্বাধীনতার কবিতা লিখে স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠাচ্ছেন, অসংখ্য সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মী যখন স্বাধীন বাংলা বেতারকে মুখর করে রেখেছেন, কবি আল মাহমুদ তখন স্বাধীন বাংলা বেতারে কী করছেন, দেখা যাক :
“এ সময় আমি মাঝে মধ্যে বালুহাককাক লেনের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অফিসে হাজিরা দিতে যেতাম । কিন্তু রেডিওতে অংশগ্রহণ করিনি । কারণ আমার পরিবার-পরিজন তখনো বাংলাদেশে অনিশ্চিত অবস্থায় কাল কাটাচ্ছিল এবং পরিবার-পরিজনের কোনো খবরই আমার জানা ছিল না ।”
কবি আল মাহমুদের সাহস বোঝা যায় এখানে ।
কবি কি তখন কিছু লিখছেন না ? লিখছেন ।
তিনি জানাচ্ছেন, আনন্দবাজার রবিবাসরীয় বিভাগে তখন তিনি ‘প্রকৃতি’’ কবিতাটি লিখেছেন । ‘প্রকৃতি’ কবিতাটি আমার পঠিত বলে স্মরণ আসছে না, তাই মন্তব্য করছি না, তবে কবিতার নাম দেখে সেটিকে যুদ্ধের সাথে সংশ্রব আছে, এমন কোনো কবিতা বলে মনে হচ্ছে না ।
এসময় কবি কলকাতা থেকে তার কাব্যগ্রন্থ বের করার চেষ্টা করেন এবং সফল হোন । সেটি ‘আল মাহমুদের কবিতা’ শিরোনামে অরুণা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় । সেখানে যুদ্ধের কোনো কবিতা ছিল বলে কবি দাবি করেননি ।
বরং তিনি এক বস্তিবাসী যুবতীর ঘরে নিরীহ রাত যাপন করেছেন বলেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাছাড়া পূর্বে উল্লেখিত রাজেশ্বরী রায়চৌধুরীর সাথে তার ঘনিষ্ট ঘুরাফেরা কানাঘুষার জন্ম দেয় বলেও ইঙ্গিত পাই আমরা ।
কবি তখন নিজেকে নিয়েই মগ্ন ছিলেন ।
“এ সময় আমার মানসিকতায় একটু শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল, কেমন যেন গা ছাড়া ভাব । আমি মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে যৌনসংযম প্রার্থনা করতাম ।”
কারণ, কবির সনেটন নিয়ে একটি মিনিবুক প্রকাশিত হয়েছিল, ‘সোনালি কাবিনে’র সেই কবিতাগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী তাদের ব্লাউজের ভেতর রাখত বলে কবি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন ।
কবির এই ঘুরাফেরা যে অনেকেরই পছন্দ হয়নি, সেটা বুঝা যায় যখন কবি আরো জানান :
“এর মধ্য একদিন হঠাৎ একটি পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ ছাপা হলো । তারা লিখেছেন, আমি নাকি ভিআইপিদের মতো পোশাক পরে কফি হাউসে ঘুরে বেড়াই ।”
কবি অবশ্য এগুলোকে নকশালপন্থী লেখকদের ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন তার বইয়ে ।
শেষ কথা
কবির আত্মজীবনী পড়ার পরে আর অন্যান্য বইয়ের রেফারেন্স টানার দরকার মনে করছি না ।
‘৭১ সালে কবি কী করেছেন, কী করেননি, সেটা উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার ।
কিন্তু সার্বিক বিচার করে মনে হচ্ছে কবি আল মা