বাঙালির ইতিহাসের আরেক কলঙ্কিত দিন
অসাধারণ চিত্তস্থৈর্য দেখিয়ে মিথ্যা মামলা আইনগতভাবে মোকাবিলার জন্যে তিনি চৌদ্দই এপ্রিলের মধ্যে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন। কিন্তু অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার দেশে ফিরে আসায় জারি করে দিল নিষেধাজ্ঞা। যেই দেশকে কেন্দ্র করে তার জীবন আবর্তিত হয়েছে, যে দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে বারবার প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়েছেন, যে দেশ এই মর্ত্যে তার কাছে মহর্লোক সাদৃশ্য, সেই দেশে প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞায় তিনি ব্যথিত হলেন, তবু একটুও দমে যাননি। অকুণ্ঠচিত্তে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, ‘কোনো শক্তি আমাকে দেশে ফিরতে বাধা দিতে পারবে না। আমি আমার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাব এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখব।’
বঙ্গবন্ধুকন্যার এই লৌহকঠিন ঘোষণায় দখলদার সরকারের কেবল পিলেই চমকে যায়নি, তারা ভীষণ ভীতও হয়ে পড়ে। তাই তো, সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশে ফিরলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তারা হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু শেখ হাসিনা সকল হুমকি-ধামকি, সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ওই বছরের সাতই মে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর সত্তর দিন বাদে শাসকচক্র তাকে মিথ্যো মামলায় গ্রেফতার করে বাংলার ইতিহাসে রচনা করেছিল আরেকটি ঘৃণ্য কালো অধ্যায়। ওয়ান ইলেভেনের সরকার যে রাতে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিয়েছিল, সে রাতে এই ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিবাদেই যেন বাদল বরিষণে কেঁদে ভাসিয়েছিল পৃথিবী। নিস্তব্ধ বিভাবরীতে সমগ্র প্রকৃতি করেছে যেন নীরব শোকের মাতম। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জননেত্রীর ধানমন্ডিস্থ সুধাসদন ঘেরাও করে রেখেছিল। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। যাতে তিনি লিখেন, ‘যে যেভাবে আছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথানত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবই।’ তার সেই চিঠি বাঙালির মনে বুনে দিয়েছিল দ্রোহ আর স্বপ্নের বীজ। বাঙালি মানসে তিনি হয়ে উঠলেন প্রদীপ্ত শিখার মতোই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। একদিকে তার প্রতি জনতার অকৃত্রিম ভালোবাসার ফল্গুধারা বইতে লাগল আর অন্যদিকে তথাকথিত কুচক্রী সুশীল সমাজ মদদপুষ্ট ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের ভ-ামীর মুখোশ উšে§াচিত হচ্ছিল যা বাঙালির মাঝে জ্বালিয়ে দিয়েছিল দ্রোহের আগুন। নানান চিতোরউতোর, নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তির দাবিতে তারা গড়ে তুলেছিল তীব্র আন্দোলন; ফলে পে-ুলামের মতো দুলতে শুরু করেছিল অবৈধ সরকারের গদি। অতপর তারা অনন্যোপায় হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে মুক্তি দিলে দীর্ঘ নিশুতির পর বাংলার বুকে উচ্চারিত হয়েছিল জয়ধ্বনি। সেই জয়ধ্বনি এখনো চলছে। কেননা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণে গণতন্ত্রকেই শুধু পুনরুদ্ধারই করেননি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে এগিয়ে গেছেন বহুদূর। তিনি দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায় আর নিজে হয়ে উঠেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি এক বিশ্ব নেতায়। (শেষ)
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমানবাঙালির আত্মপরিচয়ের নিদর্শন রক্ষা করুনস্পর্শে আসার জন্য নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা এখন জাতীয়
দাবি। কেবল তাই নয়, দেশি এবং বিদেশি দর্শক, ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকগণ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করার প্রধান নিয়ামক নিদর্শনগুলো।
পাঁচ. বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই পুরান নিদর্শন সংরক্ষণে যথেষ্ট সচেতন। কাজেই এখনই সময় আমাদের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণের হাল ধরতে হবে। আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এসব অমূল্য নিদর্শনবিলীন হলে আমরা পরিচয়হীন হয়ে পড়ব। অচিরের বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এগুলো রক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পুরাকীর্তি রক্ষায় সচেতন, আন্তরিকতার সঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারিভাবে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য জনসাধারণকে সচেতন ও সম্পৃক্তকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। প্রতœবস্তু সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট আইনকে যুগোপযোগী করে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারিভাবে পেশাজীবী দক্ষ জনবল গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা করতে হবে। যেহেতু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই সম্পদের অবস্থান কাজেই জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সচেতন ভূমিকা রাখতে পারে। সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহ বিনাশ বা অপসারণ থেকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা নেবে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর উপ-মহাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানকে আরও কার্যকর করা দরকার। এ অধিদফতর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন সংস্কৃতি চিহ্নের আবিষ্কারের মাধ্যমে ইতিহাস পুনরুদ্ধার এবং উন্মোচিত স্থাপত্যিক কাঠামোর সংস্কার সংরক্ষণ ও প্রদর্শনে আরও বেশি নজর দিতে হবে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার যোগ্য অনেক নিদর্শন আমাদের আছে। ময়নামতি, পাহাড়পুর, উয়ারি বটেশ্বর এর মধ্যে অন্যতম। কেবল পাহাড়পুর এবং ষাটগম্বুজ মসজিদ এরই মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। আরও অনেক নিদর্শন আছে যা আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারি, জানাতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা সংরক্ষণ করা হয়নি। ‘এই মাটি সোনার ভাড়া।’ দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো লুকায়িত নানা নিদর্শন। খুবই কম গুরুত্ব পাচ্ছে অনুসন্ধান এবং খনন কাজ। মাটির নিচে যেসব নিদর্শন আছে সেগুলোর সম্পর্কে ধারণা করা যায়, কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ প্রতœতাত্ত্বিক খনন ছাড়া সম্ভব নয়। এজন্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং লোকবল সংকটের কারণে অনেক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। (শেষ)
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান