সে সমাজের কপালের দুঃখ খ-াবে কে
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নিষেধ করেছেন কুরআনকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে। বলেছেন, জেনে-বুঝে অনুসরণ করার কথা। যেহেতু কুরআনের ক্ষেত্রেই এই কথা বলা হয়েছে সুতরাং অন্যসব ক্ষেত্রেও জানা বোঝার ব্যাপারটি অবশ্য প্রযোজ্য। অন্তত যারা ইসলামিস্ট বলে নিজেদের পরিচিত করতে চান। আমি বিষয়টি অবতারণা করলাম এ কারণে যে, সাম্প্রতিক সময়ে অসহিষ্ণুতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যাতে জানা বোঝার আর সময় হাতে রাখতে চাইছেন না কেউ। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা যে ইসলামের মূল দর্শনের অন্যতম কেউ কেউ তা পুরোপুরি বিস্মৃত হতে চলেছেন। রাসুল সা. এর রাস্তায় কাঁটা বিছানো হয়েছে, তিনি সবুর করেছেন। এমন একটি দর্শনের অনুসারী হয়ে কেন যে এত তাড়াহুড়া বুঝি না।
গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের থেকে বর্তমানে এগিয়ে থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তাতে কারও কথার চটজলদি জবাব দেওয়ার বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশের আতিশয্য দেখে কুরআনের কথা মনে পড়ে। সূরা বনি ইসরাঈলের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততা প্রিয়।’ ইসলামিস্ট হওয়ার সবচেয়ে বড় লক্ষণ হলো, ধৈর্যধারণ ও বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ, আবেগতাড়িত হওয়া নয়। বনি ইসরাঈলেই ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি এই কুরআনে নানাভাবে বুঝিয়েছি, যাতে তারা চিন্তা করে। অথচ এতে তাদের কেবল বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।’ স্বয়ং ‘রব’ আল্লাহতায়ালা জানা-বোঝার কথা বলেছেন, চিন্তার গুরুত্ব দিয়েছেন। এমন দর্শনের মহত্ব ও উদ্দেশ্য বোঝার মানসিক শক্তি ও সামর্থ্য যারা রাখে না, তাড়াহুড়া তো তাদের কাজ।
দুই. যারা নাস্তিকতার কথা বলেন কিংবা যারা মার্কসবাদী। কার্ল হাইনরিখ মার্কস বা হাইনরিশ মার্কস, এঙ্গেলসের সাথে মিলে যে রাজনৈতিক দর্শন দিয়েছিলেন তাই মার্কসবাদ। সব দর্শনই যে ধর্মভিত্তিক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, যেমন কথা নেই ধর্ম পালন করলেই ভালো মানুষ হওয়া যাবে তা নিয়ে। মার্কসবাদও একটি দর্শন, মার্কসিস্টরাও একটি দর্শনের অনুসারী। ইহুদি পরিবারের সন্তান হয়েও মার্কস ‘নাস্তিকতাবাদে’র অনুগামী হন। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের অভিজাত ধারণার বিপরীতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে তিনি তার রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করেন এবং প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার জীবনচরিতে তাড়াহুড়ার কোনো ব্যাপার আছে কী? যারা মার্কসিস্ট, সাম্যবাদের কথা বলেন, তাদেরও তো বুঝে-শুনে কাজ করার কথা, কাজের আগে হোমওয়ার্ক করার কথা। গণ ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের আলোচনা, যুক্তি তথা কাজ-কারবারে তো তার প্রতিফলন দেখি না। কেন দেখি না? রাজনৈতিক মুক্তি তো তাড়াহুড়া করে ঘটে না। তার জন্য লাগে বিপুল আয়োজন, প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতি কই? প্রস্তুতির যে বহর নিয়ে তাড়াহুড়ো করেন, তাতে তো নিশ্চিত কুপোকাত। তিন. ইসলামিস্ট বলেন বা মার্কসিস্ট, কিংবা কমিউনিস্ট এই ‘মিস্ট’ ‘সিস্ট’ আর ‘নিস্ট’ হতে গেলে প্রয়োজন মেধার, নিজস্ব যুক্তি ও চিন্তার তীক্ষ্মতার। যাতে আপনি যা পড়েছেন, জেনেছেন তার যেন অন্ধ অনুগামী না হন, অন্ধ অনুসারী না হন। নিজস্ব যুক্তি বা চিন্তা যদি অনগ্রসর হয় তাহলে হাজার পড়েও লাভ নেই। এক্ষেত্রে আমি একটি বিষয় মানি, ‘না বুঝে বেশি পড়ার চেয়ে, বুঝে কম পড়া ভালো’। যতটুকু নেওয়ার সামর্থ্য আছে তার বেশি নিতে গেলে তো স্বভাবতই পাত্র উপচে পড়বে। সবারই দর্শন নিয়ে ভাবতে হবে, চিন্তাশীল বা বুদ্ধিজীবী হতে হবে, এমন তো কথা নেই। যার অনুধাবনের কমতি আছে, অনুভবের ঘাটতি আছে তার কষ্ট করে চিন্তাশীল সাজার প্রয়াস কেন? বুদ্ধিজীবী সাজার চেষ্টা কেন? হওয়া এবং সাজার মধ্যে যে অনেক পার্থক্য, অনেক ফারাক।
চার. সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু ব্যাপারে নানাপদের বুদ্ধিজীবী (?) দের হঠাৎ উত্তেজনাময় প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় হয়, এরা না সমাজে বড় কোনো গ-গোল পাকিয়ে ফেলেন। আবেগ এবং বিবেকের কনফ্লিক্ট তো এদের বোধের বাইরে। এরা সবকিছুই সারতে চান আবেগ দিয়ে, সে মৈথুন ক্রিয়াই হোক আর কলম চালনাই হোক। আবেগ আর উত্তেজনাই তাদের মূলকথা। যে সমাজে বিবেক নির্বাসিত হয়, আবেগ আর উত্তেজনাই মুখ্য হয়ে উঠে, সে সমাজের কপালের দুঃখ খ-াবে কে!
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান