ডানা কাটা পরী
যায়নুদ্দিন সানী
বাসে উঠলেই আমি একটা টেনশনে থাকি। হিসু। সো, এসব যাত্রাবিরতিতে খাওয়া-দাওয়া সারি আর না সারি, টয়লেটে অবশ্যই যাই। বাসের বাকই জনতার সঙ্গে আমিও নেমে গেলাম। ফরহাদ তখনো বাসে বসে আছে। ওর হাবভাবে মনে হচ্ছে মেয়েটা যদি না নামে, সেও নামবে না। আমি নেমে দ্রুত আমার গন্তব্যের দিকে এগোলাম। দ্রুত কাজটা সারতে চেষ্টা করলাম, হলো না। রাজ্যের পানি যেন আমার শরীর থেকে বেরোনো শুরু করল। এরপরে যত দ্রুত সম্ভব ওখান থেক বেরিয়ে খাবারের এলাকায় আসলাম। সন্ধানী চোখ দুটোতে রাডার ফিট করে খুঁজতে শুরু করলাম। যদিও আমার খোঁজা উচিত ফরহাদকে, কিন্তু আসলে খুঁজছি মেয়েটাকে। কিংবা হয়তো দুজনকে একত্রে। এতক্ষণে কি আলাপ শুরু করে ফেলেছে? কতদূর এগোল। কি কি জানতে পারল? নাকি কিছুই হয়নি? আমার চোখ তখনো ওদেরকে খুঁজছে। পেলাম না।
তাহলে কি বাস থেকে নামেনি? এই এসি বাসগুলো আবার যাত্রী নাম্বার পরে লক করে দেয়। সো কেউ যদি ভেতরে থাকে আগামী বিশ মিনিট ভেতরেই থাকবে। ওরা দুজনই কি ভেতরে? ইস, মিসড দ্য অপারচুনিটি। কেন যে নামলাম? গাড়িটা খুঁজতে লাগলাম। যেখানে নামিয়েছিল, সেখানে নেই। অনেক সময় গাড়ির ভিড় বেশি হলে আশেপাশেই, একটু এদিক-ওদিক পার্ক করে। বাস আজকে অনেকগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরটা যেহেতু আলাদা চেহারার, তাই চোখে পড়ার কথা। কোথায় গেল?
এমন সময় বাসটা নজরে পড়ল। বের হওয়ার সুবিধার জন্য ড্রাইভার বুদ্ধি করে রাস্তার পাশে রেখেছে। যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল, তার থেকে অনেকটা পেছনে। দ্রুত বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। যা ভেবেছি, ঠিক তাই। নামেনি। এবং যথারীতি গল্প জুড়ে দিয়েছে। আমাকে যেন দেখতে পায় তেমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লাম। একবার মনে হয় দেখতে পেল, কিন্তু প্রত্যুত্তর দিল না। কোনো ইশারাও করল না। না করারই কথা। ওর জায়গায় আমি থাকলে, আমিও তাই করতাম। শালাকে হিংসে হচ্ছে এখন। ফোন করব? করা তো যায়ই, বাট ধরবে?
এমন সময় কাঁধে একটা হাত পড়ল। ঘুরে দেখি শিবলি। আমাদের সঙ্গেই পড়ে। সিলেট মেডিকেল কলেজে। ছুটি শেষে সেও ফিরছে। অনেকে অবশ্য গতকালই ফিরেছে। আমরা কজন ব্যাকবেঞ্চার গ্রুপ একটু পড়ে আসছি। প্রক্সি দেওয়ার লোক সেট করা আছে, সো পার্সেন্টেজ নিয়ে সমস্যা হবে না। শিবলি গল্প শুরু করবার পাঁয়তারা করছিল, আমি থামালাম। মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। বললাম,
Ñ ফোনটা একটু দিস তো দোস্ত।
ফোনটা এগিয়ে দিল। আমার মোবাইল থেকে ফরহাদের নম্বরটা দেখে টুকে নিলাম। শিবলি বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। তাই না চাইতেও ব্যাখ্যা দিলাম
Ñ ব্যালেন্স শেষ দোস্ত।
রিং বাজছে। শিবলি ঠিক আমাদের ফ্রেন্ড গ্রুপের না। ওর নাম্বার ফরহাদের কাছে না থাকারই কথা। আননোন নম্বর দেখেই বোধহয় ফোনটা ধরল।
Ñ শালা, ফোন ধরছিস না কেন?
Ñ তুই? এরপরে ফিসফিস করে বলল ‘ডিস্টার্ব করিস না।’
Ñ কতদূর এগোলি?
Ñ অলমোস্ট দেয়ার।
এরপরে লাইন কেটে দিল। দূর থেকে দেখছি হাত পা নেড়ে বেশ আনন্দের সঙ্গে কিছু একটা বোঝাচ্ছে মেয়েটাকে। মেয়েটাও ওর কথায় দারুণ হাসির কিছু খুঁজে পেয়ে খিলখিল করে হাসছে। হোস্টেলে রুমে পৌঁছতে বিকেল চারটা বেজে গেল। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রুমে এসে ঢুকলাম। ফরহাদ আসেনি। ওর বোঁচকা আমার ওপরে চালান করে দিয়েছে। আমার হাতে ওর ব্যাগের ট্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
Ñ রুমে রেখে দিস।
আমিও বন্ধুর নির্দেশ মতো ওর বোঁচকা এবং আমার ব্যাগ নিয়ে টলমল করতে করতে রুমে এসে পৌঁছলাম। নিচে দারোয়ান ছিল না, তাই দুটো ব্যাগই আমাকে টানতে হলো। রাগে গা জ্বলে যাওয়া বলতে যা বোঝায়, এই মুহূর্তে আমার অনুভূতি অনেকটা তেমনই। খেতে যেতে ইচ্ছে করছে না। আজকে ডাইনিং হবে না, সামনের হোটেলে যেতে হবে। অবশ্য ফোন করে দিলে রুমে দিয়ে যাবে। ও নো, ফোনও তো করতে পারছি না। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। রুম হাতড়াতে শুরু করলাম। বিছানার নিচে একটা টিনে আছে, যেটা হচ্ছে আমাদের ইমাজেন্সি ফুড ব্যাঙ্ক।
টিনটা বের করলাম। হাতে নিয়ে মনে হলো ভেতরে কিছু আছে। টোস্ট টাইপ কিছু হলেও আমার চলবে। টিন খুলে বেশ অবাক হলাম। টোস্ট বিস্কুটে ভর্তি। কে আনল? এই রুম আমাদের তিনজনের। অন্য রুমমেট মনে হচ্ছে এখনো আসেনি। বিছানা ওল্টানো। কে আনল তাহলে? ছুটির আগে কি কিনে রেখে গিয়েছিল কেউ? তাহলে তো নেতিয়ে গেছে। একটা হাতে নিলাম। টিপে দেখলাম, ভালোই তো আছে। কামড় দিলাম। এ তো টাটকা। মনে হচ্ছে আজকেই কেনা। বিছানায় হেলান দিয়ে খেতে শুরু করলাম আর সঙ্গে চলতে থাকল আজকের সারাদিনের স্মৃতি রোমন্থন।
ফুড ভিলেজে খাবার বিরতি শেষ হওয়ার পরে বেশ অনেকগুলো ঘটনা ঘটল। শুরু থেকেই বলি। (চলবে-০২)
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান