দোরগোড়ায় হজ : প্রস্তুতি কতটুকু
া মুফতী আজীজুল্লাহ আশরাফ কাসেমী
হজ গুরুত্বপূর্ণ মহিমান্বিত ইবাদাত। ইসলামের মৌলিক পঞ্চস্তম্ভের একটি (বুখারী: ৭)। যা প্রত্যেক সুস্থ সাবালক সামর্থবান মুমিনের উপর ফরজ। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘পথের ব্যায় বহনে যে সামর্থ রাখে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাইতুল্লার হজ করা তার দায়িত্ব’ আলে ইমরান:৯৭।
ইমানের পর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইবাদাতের হলো ‘হজ্জে মাবরূর’ (বুখারী: ২৬)। দারিদ্রতা ও যাবতীয় গুনাহ অবমুক্ত হতে কার্যকরী পন্থা হিসেবে হজের কথাও বলেছেন রাসূলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তিরমিযী: ৮১০)। তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি (সুন্নত মোতাবেক) হজ করলো, এবং কোন গুনাহে জড়ালো না, সে যেন সদ্য ভূমিষ্ট নবজাতকের ন্যয় (নিস্পাপ হয়ে) ঘরে ফিরলো (বুখারী: ১৪২৪)। এবং উক্ত হজের প্রতিদান জান্নাত (বুখারী: ১৬৫০)।
বিপরীতে সামর্থ স্বত্ত্বেও যে ব্যক্তি হজ করেনি, সে অধর্ম নিয়ে মরতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাসূলে কারীম সা. (তিরমিযী: ৮১২)। অতএব মুমিন-জীবনে হজ কতটা গুরুত্ববহ তা সহজেই অনুমেয়। তাই উক্ত গুরুত্বের দাবি হিসেবেই হজের সুন্দর ও সতর্ক প্রস্তুতির কথা বলে থাকেন বিজ্ঞজন। প্রকৃতার্থে কুরআনুল কারিমেই এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘তোমরা (হজের জন্য) পাথেয় অর্জন কর। আর তাকওয়ার পাথেয় হলো শ্রেষ্ঠ পাথেয়। সূরা বাকারা: ২৯৭। উক্ত আয়াতের প্রথমাংশে বাহ্যিক প্রস্তুতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। দ্বিতীয়াংশে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আত্মিক প্রস্তুতিই হলো শ্রেষ্ঠ প্রস্তুতি। প্রথমটিতে ঘাটতি হলে হজের ক্ষতি হতে পারে। দ্বিতীয়টিতে ঘাটতি হলে হজের ফলাফল ‘জিরো’তে নেমে আসতে পারে। তাই আল্লাহর ঘরে গমনেচ্ছু প্রত্যেক ইমানদার নর-নারীকে উভয়বিধ প্রস্তুতি প্রথমেই সম্পন্ন করতে হবে। পূর্ব প্রস্তুতির অভাবে যদি হজের আমল বিনষ্ট হয়, তাহলে হজের এতসব আয়োজন, নিজস্ব শ্রম সময় ও অর্থ সবটাই বিফলে যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা হেফাজত করুন!
হজ যেহেতু কষ্টসাধ্য ইবাদাত, তাই সঠিক ও সুচারুরূপে পবিত্র হজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজন হয় বিন্যস্ত মানসিকতার। মনোবল ও হিম্মতে পরিপূর্ণ হৃদয়ের। উক্ত মানসিকতা তৈরিতে প্রথমেই প্রয়োজন হজের যাবতীয় আমলের সাথে ‘অপরিচিতি’র ভাব দূর করা। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, হজকে ঘিরে ব্যবহৃত যাবতীয় পরিভাষা আত্মস্থকরণ, এবং সুযোগ হলে হজের গ্রহণযোগ্য সংক্ষিপ্ত কোন সফরনামা পাঠ উক্ত মানসিকতা তৈরিতে সাহায্য করবে আশা করি।
মক্কা, মদীনা, মীনা, মুযদালিফা ও আরাফার ময়দানের ম্যাপ দেখা, সেখানে ঘটিতব্য সম্ভাব্য সমস্যাগুলোর ধরণ ও তার প্রতিকার ইত্যাদি জেনে নেওয়াও ভালো হবে। সর্বোপরি কষ্ট সহিষ্ণুতার মেজাজ গড়ে নিতে হবে। কারণ, মানুষের অজ্ঞতা, আবেগের অযতœ প্রকাশ, নিয়ম-শৃঙ্খলা না মানা, স্থান ও রাস্তা-ঘাটের অপ্রতুলতা, যানজট ও জনজট এমনসব সমস্যার মুখোমুখি করতে পারে, ধৈর্য ছাড়া যার কোন সমাধান নেই।
এরপর আত্মিকভাবে প্রস্তুত হতে প্রথমেই নিয়তকে শুদ্ধ করে নিতে হবে। সামাজিক মান-মর্যাদার আশা, নামের প্রারম্ভে আলহাজ লাগানোর মনোবাঞ্চনা, নির্বাচনে জনতাকে প্রভাবিত করার মত মানসিকতা থাকলে প্রথমেই তা পরিহার করতে হবে। দোয়া করতে হবে: ‘হে আল্লাহ! এমন হজের তৌফিক দাও, যা হবে রিয়া ও সুনাম কুড়ানোর মানসিকতা হতে মুক্ত’ (ইবনে মাজাহ: ৮৯০)।
এরপর হজের নিয়তের পর থেকেই মনেপ্রাণে নিজেকে সংশোধনের ইচ্ছা রাখতে হবে। অতীতের গুনাহের জন্য তওবা করতে হবে। কাযা-কাফফরার সুযোগ থাকলে সেগুলে আদায় করতে হবে।
কোন ব্যক্তির হক নষ্ট করে থাকলে তার হক বুঝিয়ে দিতে হবে। অন্তত ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। হজ পালনকালে ঝগড়া বিবাদ নিষেধ। তাই নিজ অধিকার বঞ্চিত হওয়ার প্রাক্কালেও যেন ঝগড়ার পরিবেশ তৈরি না হয় সেরকম মেজাজ এখন গড়তে হবে।
হজের যাবতীয় আমল যিকিরের উদ্দেশ্যেই। সূরা বাকারার ১৯৮, ২০০ ও ২০৩ নাম্বার আয়াত এমনটিই বুঝা যায়। তাই হজ চলাকালীন আল্লাহর ধ্যান ও স্মরণ যেন সদাসর্বদা হৃদয়কে আন্দোলিত করতে থাকে সেরকম মনন তৈরি করতে হবে। আর তা হঠাৎ করেই হবেনা, এখন মনোযোগী হতে হবে।
হজের মূল স্লোগান হলো ‘তালবিয়া’। যার মূল বক্তব্যই হচ্ছে খোদার লা-শারীকত। আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব পরিচালনায় তার কোন অংশিদার নেই। হজ পালনকালে ও হজ পরবর্তী নিজের জীবনেও যেন কখনো শিরকের ছোঁয়া না লাগে এ ব্যপারে সজাগ থাকতে হবে। এগুলো হলো প্রস্তুতি পর্ব। উক্ত পর্ব ও পরবর্তী হজকার্য সম্পাদন পর্বতে যদি কোন হক্কানী অভিজ্ঞ আলিমের তত্বাবধানে পরামর্শপূর্বক যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেওয়া যায়, তবে সেটাই হবে সর্বোত্তম পন্থা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর ঘরে গমনেচ্ছু সকলকে ‘হজ্জে মাবরূর’ নসীব করুন এবং তাঁদের উসীলায় মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্ববাসীর জন্য শান্তির ফয়সালা করুন। আমীন!