জাটকা এলাকা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দরকার
ড. মো. শামছুল আলম
চলতি বর্ষা মৌসুমে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। জুলাই থেকে বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশ দেশের নদ-নদীতে আসতে শুরু করেছে। চলতি মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদফতর। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব মতে, দেশে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ, আয়তন এবং ওজনও বেড়েছে। তবে আমাদের কৃষি ব্যবস্থার পুরোটাই প্রকৃতির উপর যেমন নির্ভরশীল ঠিক তেমনি মৎস্য খাতও আমাদের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি যখন ফেভারে থাকে তখন ইলিশের উৎপাদন বেশি হয়। তারপরও ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ম্যানেজমেন্টের কিছু বিষয় থাকে। যেমন জেলেদের জাটকা মাছ না ধরার বিষয়টি নিশ্চিত করা। জেলেদের বেশি বেশি বোঝানো যে, জাটকা না ধরলে এই মাছটাই একদিন অনেক বড় হবে এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা ম্যানেজমেন্টের অবশ্যই একটা পজিটিভ দিক। যার ফলে প্রকৃতির সহায়তা এবং ম্যানেজমেন্টের জাটকা নিয়ন্ত্রণের কারণে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
উৎপাদন ধরে রাখা বা জাটকা সংরক্ষণের জন্য আমাদের মৎস্য বিভাগ থেকে ইলিশের পাঁচটি অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে। তবে এই অভয়াশ্রম নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে। যদিও অভয়াশ্রম ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জাটকা সংরক্ষণে সহায়তা করবে। এই অভয়াশ্রমগুলো কতটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা হয়েছে সেটা একটা বিষয়। অভয়াশ্রম করা মানে যেখানে মাছ ধরা বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থাকে। সেখানে ইচ্ছে করলে অন্য কেউ মাছ ধরতে পারবে না। ইলিশের জন্য অভয়াশ্রমটি কতটুকু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে করা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। আমার প্রশ্ন হলোÑ এই অভয়াশ্রম পাঁচটি না করে তিনটি করা হলো না কেন। অবার পাঁচটির বেশি করা যেত কিনা।
পদ্ম-মেঘনা-যমুনা নদী, সুন্দরবনের অংশ, বঙ্গোপসাগর এবং পটুয়াখালী অঞ্চলে যে ইলিশ মাছগুলো ডিম ছেড়ে চলে যায়, আবার ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। জাটকা ইলিশ হওয়ার পরে সেগুলো আবার ফিরে যায় সমুদ্রে। মনে করুন, ইলিশ পদ্মাতে ডিম ছাড়ল। ডিম ছেড়ে দেওয়ার পর সেগুলো আবার মেঘনা হয়েই সমুদ্রে চলে যাবে। এটা ইলিশের প্রধান রোড হিসেবে বিবেচিত। আবার মেঘনার ওপারে যে মাছগুলো ডিম ছাড়ে সেখানেও আবার জাটকা তৈরি হচ্ছে। সেখান থেকে তারা চলে যাবে বঙ্গোপসাগরে। সেই মাছগুলো আবার ডিম ছাড়ার জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে নদীতে চলে আসবে।
অন্যদিকে মেঘনা এবং অন্যান্য জায়গায় যে জাটকাগুলো তৈরি হলো এরা সবগুলো যাবে কিন্তু বঙ্গোপসাগরে। এরা সেখানে বড় হয়ে পরবর্তী বছর বা তার পরের বছর নদীতে চলে আসবে। এখন একটা প্রশ্ন সেটা হলোÑ আসলে যে মাছগুলো বঙ্গোপসাগরে গেল সে মাছগুলো কোন নদীতে যাবে? যার যেখানে জন্ম সেখানে যাবে, না অন্য কোথাও যাবে। এটার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা বা ঠিক ঠিকানা নেই। এই মাছগুলো কোন জায়গায় যাবে সেটা কিন্তু আমাদের জানা নেই। জানা না থাকার কারণে যেটা হচ্ছে, সরকার যখন জাটকা সংরক্ষণের কথা বলছে তখন জেলেরা কিন্তু জাটকা সংরক্ষণের কথা খুব গুরুত্ব বা মনোযোগ দেয় না। তার কারণ হলো জেলেরা অনেক সময়ে এই জাটকাগুলো ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এর আরেকটা কারণ হলোÑ আমরা কিন্তু জেলেদের বেশি ইলিশ ধরার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।
আমরা কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারছি না যে, এই জাটকা মাছটাই একদিন বড় হয়ে আপনার এলাকায় আসবে বা আপনার জালে ধরা দিবে। জাটকা মাছটা পরবর্তীতে কোন এলাকায় বা জায়গায় যাচ্ছে এটা জানা এবং তা বের করা সম্ভব। তখন তারা জাটকা সংরক্ষণের স্বার্থে সেটা বুঝতে পারত। ফলে জেলেরা জাটকা না ধরে পরবর্তীতে সময়ের জন্য অপেক্ষা করত বেশি মাছ ধরার আশায়। এবং সেটা তাদের জীবিকার জন্য আরও সহায়ক হবে।
জেলেরা আজ মনে করছে আজকে যে জাটকা মাছটা ধরছি না সে মাছটা চলে গেলে তো চলেই গেল। আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। এই বিষয়গুলো নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা হওয়া দরকার। আজ প্রকৃতি বা আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমাদের এই উৎপাদন যেন না কমে যায় সেটার জন্য আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন ইলিশের মিনিয়াম লেভেলের প্রতিবছর উৎপাদন হয়। সেটার জন্য গবেষণা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার যেন লেভেলটা ধরে রাখার স্বার্থে।
পরিচিতি: অধ্যাপক, ফিসারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত গ্রহণ: বায়েজিদ হোসাইন
সম্পাদনা: আশিক রহমান