নগরীর যানজট : শুধু ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে!
ডা. জাকির হোসেন
গত বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে ২০৩৫ সালে ঢাকার উন্নয়ন শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘টোয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা: এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শীর্ষক খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে বত্রিশ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এই প্রতিবেদনে আরও কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়। যেমনÑ যানবাহনের গতির বিষয়ে বলা হয় গত ১০ বছরে যানচলাচলের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নেমে এসেছে। যা মানুষের পায়ে হেঁটে চলার গড় গতি (৫ কি.মি.) থেকে সামান্য একটু বেশি। নগরবাসী ও বস্তিবাসীর ক্ষেত্রে এই প্রতিবেদনে একটি তথ্য প্রকাশ করা হয়, যাতে বলা হয় প্রায় ৩৫ লাখ বস্তিবাসীসহ নগরের অনেক অধিবাসী প্রায়ই মৌলিক সেবা, অবকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিবেদনের অনেক বড় একটি ইস্যু ঠাঁই পায়নি বলে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার ঘোর আপত্তি। এই প্রতিবেদনে প্রতিদিন কর্মঘণ্টা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির ইস্যুটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে দেশ শুধু আর্থিকভাবে অগ্রসর হলেই কী আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যাবে? আমি চিকিৎসক হিসেবে বলব, এটা মোটেই ঠিক ধারণা নয়। কেবল একটি সুস্বাস্থ্যবান জাতিই পারে তার উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে এবং সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। তিলোত্তমা নগরী ঢাকার আজকের বাসিন্দাদের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ যানজটের কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই প্রতিবেদনে এই বিষয়টি একেবারেই প্রাধান্য পায়নি। গাড়ির কালো ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করছে এবং সেই বাতাসে থাকা বস্তুকণা ও সালফার-ডাইঅক্সাইড ফুসফুস, কিডনি জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা কমিয়ে দেওয়া, ফুসফুসে নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করছে বাতাসে থাকা মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন-ডাইঅক্সাইড ও সিসা। তাছাড়া র্দীঘসময় যানজটের কবলে পড়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, মাথাব্যথা, মানসিক চাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, অতিরিক্ত ঘাম, অ্যালার্জি, বদহজম, বমি, ক্লান্তি ও দিনে দিনে চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়ার সমস্যা তো প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে।
প্রতিটি স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে মানুষ অন্তত দুইভাবে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমত, রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে সরাসরি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে চিকিৎসার পেছনে। দ্বিতীয়ত, অসুস্থতা স্বল্পমেয়াদে কিংবা দীর্ঘমেয়াদে উপার্জনসক্ষম ব্যক্তির উপার্জনে অক্ষম করে তুলছে। যানজট নিরসন কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে অনেক আলোচনা হলেও স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে আর্থিক ক্ষতির বিষয়গুলো তুলে ধরার মতো স্বাস্থ্যখাতের প্রতিনিধি না থাকার কারণে সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ। যানজটের কারণে স্বাস্থ্যগত সমস্যার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের এবং দাতাসংস্থাগুলো বোঝানো অতীব জরুরি।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান