‘অতি’ থেকে ‘অতিশয়’ এবং প্রাপ্তির গল্প
কাকন রেজা
‘অতি’ সবকিছুই খারাপ। ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ প্রবাদ বাক্যটি এমনি এমনি প্রচলিত হয়নি। চারিদিকে ‘অতি’র আতিশয্য দেখা গেলে নিশ্চিত হবেন ‘চোর’ও রয়েছে আশেপাশেই। আরেকটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে ‘চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে’ সুতরাং চোর সবকিছু নিয়ে যাবার আগেই ‘বুদ্ধি’র বৃদ্ধি কাম্য। না হলে যেতে যেতে যেটুকু আছে তাও যাবে।
সে যাক, কদিন ধরেই তোলপাড় এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে। তারিক সালমন, যতটুকু মাধ্যমের কল্যাণে জানলাম তিনি ‘কবি’ মানুষ। কবি মানেই আবেগ সম্পন্ন একজন, মানে সাধারণের চেয়ে গড়পরতা একটু বেশি। ‘অতি’ আবেগ থেকেই হয়তো ভদ্রলোক একটি কাজ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বাঘের উপরেও ‘টাঘ’ আছে। ‘অতি’র উপর রয়েছে ‘অতিশয়’, সেই ‘অতিশয়ে’ আক্রান্ত হলেন সেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ‘অতিশয়’ মামলা করে দিলেন এবং এ বিষয়ক সব কাহিনী আপনাদের জানা। নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে সর্বশেষ হলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং কবি তারিক সালমন ‘বিশেষ অবদানে’র জন্য পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। ‘অতি’ আনন্দের কথা।
প্রথম আলো জানাল, তারিক সালমনের মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহারের এই খবরে পুলিশ সূত্রকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলো জানিয়েছে, গাজী তারিক সালমনকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় বরিশাল আদালত পুলিশের ছয় সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রশাসনিক কারণে ওই পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রথম আলোর কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে ঠিক বোধগম্য হলো না এখানে পুলিশের ওই ছয় সদস্যের দোষ কী? আইন তো সব মানুষের জন্য সমান হওয়া উচিত, একজন সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আমজনতা সবাই তো আইনের আশ্রয়ে সমান সুযোগপ্রাপ্তির অধিকারী হওয়ার কথা, তাই নয় কী? পুলিশের ওই ছয় সদস্য যদি শাস্তি পান, তবে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বাদ গেলেন কেন? জেলা প্রশাসকও কমিশনারের নির্দেশে তারিক সালমনকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছিলেন, মাধ্যমগুলো তো এমনটাই জানিয়েছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদেরও নিজ গাফিলতির দিকটি ভেবে দেখা উচিত।
ভেবে দেখার বিষয়ে ‘ভেবে’ দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে পুরো বিষয়টিই কেমন যেন অগোছালো। মনে হচ্ছে একটি বিষয় দ্রুত হ্যান্ডেল করতে গিয়ে সবকিছুতেই সমন্বয়হীনতার প্রকটত্ব দৃশ্যমান হয়েছে। সবকিছুতেই ‘অতি’ তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে, কেমন যেন জট পাকিয়ে ফেলা হচ্ছে, বাড়ছে উত্তরহীন প্রশ্নের সংখ্যা। যেমন প্রথম আলোর খবরের রেশ ধরেই যদি জানতে চাই মামলাটি দ্রুত প্রত্যাহারের কী প্রয়োজন ছিল? বরং মামলাটি চলতে দিয়েই প্রমাণ করা যেত তারিক সালমন ছিলেন নির্দোষ এবং এই মামলাটি থেকেই একটি নির্দেশনা আসতে পারত, কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না, এমন বিষয়ে। এতে সবপক্ষই উপকৃত হতো এবং এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন আর কাউকে হতে হতো না।
‘অতি’দ্রুতই কেন সব করতে হবে, হয়তো কিছু কথা হবে, সমালোচনা হবে কিন্তু আখেরে যখন সবাই দেখবে স্থিরতায় উপকার ও প্রশান্তি দুটোই আছে, তখন এমনিতেই সব সমালোচনা মিইয়ে যাবে। একটা কথা মানতে হবে, ‘অতি’তে প্রাপ্তির চেয়ে ক্ষতিই বেশি। আর ‘যতি’ তথা স্থিরতায় ক্ষতির চেয়ে প্রাপ্তিই অধিক। আর সেই প্রাপ্য ‘প্রাপ্তি’ সর্বগ্রহণযোগ্য এবং সাথে দীর্ঘস্থায়ীও।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান