আমার প্রিয় মানুষ, ‘ইভেন্ট ম্যানেজার’
ড. সা’দত হুসাইন
স্কুলজীবনে রচনা লেখার জন্যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দেখতে পাওয়ার আশা নিয়ে যে কটি বিষয়ের ওপর আমরা ভালভাবে প্রস্তুতি নিতাম তার একটি হলো, ‘তোমার জীবনে সবচাইতে প্রিয় ব্যক্তি।’ স্বাভাবিকভাবে আমরা মা-বাবা, বড় ভাই-বোন বা নিকট আত্মীয় কাউকে চিহ্নিত করে তার ওপরে কিছু লিখে প্রায় মুখস্ত করে ফেলতাম। প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে স্কুল ছেড়েছি। পঞ্চাশ বছর ধরে কর্মজীবনে আছি, যার সিংহভাগ কেটেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। গত দুদশকের অভিজ্ঞতায় এক নতুন প্রিয় ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেয়েছি। আমার জন্য সে যতটা প্রযোজ্য, তার থেকে অনেক বেশি প্রযোজ্য সে আমার অনুজ সহকর্মীদের জন্য। এই ব্যক্তি হচ্ছে ‘ইভেন্ট ম্যানেজার’।
আজকাল রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সুযোগ পেলেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কৌশল ব্যবহার করছে। মূল কাজে পারফরমেন্স যাই হোক না কেন, নানা রং ঢং এর মাধ্যমে তাকে রঞ্জিত করে, (অতিরঞ্জিতও হতে পারে) কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থাপন করে বিভিন্ন সংগঠন বাহবা নিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; সফলও হচ্ছে। বছর শেষে বিশদ হিসাব করলে দেখা যাবে, ভেতরে সবই ফাঁপা। সত্যিকার পারফরমেন্সে কোনো উন্নতি নেই। ইভেন্ট ম্যানেজারের বদৌলতে ‘পাওয়ার পয়েন্ট’, লেজার বিচ্ছুরণ, ফটোশপ, ক্যামেরা কারসাজি ব্যবহার করে এমন একটা ফুলঝুরি সৃষ্টি করা হয়েছে যে উদ্যোক্তা বা উপস্থাপনকারী সংগঠন তাদের কাজের মাধ্যমে চারদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা হয়তো বা ভেলকিবাজি। চোখের ধাঁ ধাঁ।
গত কয়েক বছর ধরে চলছে রং এর মেলা, সং এর খেলা। আর্থিক সেক্টরে নিখুঁত হিসাব নিকাশ, পরিচ্ছন্ন লেন-দেন এবং কাঠামোবদ্ধ দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মূল দায়িত্ব। সে কাজ ছেড়ে তারা মেলা-প্রদর্শনী, ফানুস-ওড়ানো নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। এদিকে খেলাপি ঋণের ভারে প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ছে, ভর্তুকির চাপে করদাতা নাগরিকরা দিশেহারা, প্রতিষ্ঠানের মূলধন ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অথচ সুন্দর কভারের দামি কাগজে ছাপানো বই এ এর কোনো নিদর্শন নেই। সবই ভালো, সবই আনন্দদায়ক। বাহবা, হাতে তালি। চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পদক বিতরণ। আমানতকারীরা সন্ত্রস্ত, দেশের মানুষ তিতি-বিরক্ত। তাদের আমানত ঠিক থাকবে কিনা এত চিন্তায় তারা অস্থির।
‘সাগর চুরি’, রিজার্ভ চুরি, যানজট, জলাবদ্ধতা, রাস্তায় লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া, খুন-ধর্ষণ, বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের অসহনীয় বৈষম্য, চালের দাম এসব তো মেলা, প্রদর্শনীতে স্থান পাচ্ছে না। ইভেন্ট ম্যানেজাররা অতি কৌশলে এসব সরিয়ে রেখেছে। তারা দর্শককে, সাধারণ মানুষকে বোকা বানাতে দক্ষ। কারণ তারা অতিচালাক। গলায় দড়ি না পরা পর্যন্ত তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চকচকে চেহারার, মচমচে কথা বলার এ ব্যক্তিরা তাই আমাদের অতিপ্রিয়। এদের বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে আমরা মিশন, ভিশন, সিনারিও, ড্রিম, পাইপড্রিম এবং ‘হ্যালুচিনেসন’ রচনা করি। রোড-শো, সার্কাস-শো, পাপেট শো আয়োজন করি। ধী-শক্তি প্রয়োগ করে যথার্থ হোক না হোক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কলোকিয়াম, ব্রেন-স্টরসিং, স্টাম্পস্পিচ, সিমুলেশান অনুশীলন, প্যারিপ্যাটেটিক মোটিভিশন সেশন ইত্যাদি দিয়ে শিক্ষিত সজ্জনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সর্বত্রই আমাদের জয়গান। একটি গল্প দিয়ে লেখা শেষ করছি। সরকারের সচিব হিসাবে আমি একটি জেলায় সফরে গিয়েছিলাম জেলা প্রশাসক রংবেরং একটি বাঁধানো প্রতিবেদন খুলে জেলা প্রশাসন কর্তৃক সম্পন্নকৃত কাজকর্ম এবং উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের ফিরিস্তি দিতে লাগলেন। তখনকার দিনে জেলা প্রশাসকদের প্রিয় বাক্য ছিল, ‘স্যার গত ক মাসে আমি সব স্ট্রিমলাইন করে ফেলেছি। এখন আর আগের মতো অগোছালো বা অর্ধ সম্পন্নকৃত কাজ নেই।’ এই জেলা প্রশাসকও রিপোর্টের বিভিন্ন পাতা উল্টিয়ে দেখাচ্ছিলেন কিভাবে তিনি নিজে এই দৃষ্টিনন্দন প্রতিবেদন-বইটি তৈরি করেছেন। অসুবিধা দেখা দিল একটু পরে। কিছু পরিসংখ্যান এবং তথ্যে গরমিল দেখা দেওয়ায় আমি জেলা প্রশাসককে স্পষ্টীকরণ করতে বললাম। অমনি থলের বিড়াল বেরিয়ে গেল। জেলা প্রশাসক বললেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট, তুমি একটু বুঝিয়ে বলো। তোমরা কীভাবে এসব বানিয়েছ তা তো আমার জানা নেই। আমি ব্যস্ত ছিলাম, তাই এসব দেখার আমার সময় হয়নি।’ ম্যাজিস্ট্র্রেট বলল, ‘জি স্যার। আমি চেষ্টা করে দেখি।’
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি