এবার তোরা মানুষ হ
ফাহমিদা হক
শিক্ষা জাতির মেরুদ-। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতির ভিত্তি ততই মজবুত। জ্ঞানের পরিধি যার যত বেশি প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে সেই টিকে থাকার যোগ্য। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা পরিভ্রমণ করে তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর উপযোগী করে তোলা। শিক্ষা গ্রহণ বা জ্ঞান অর্জনের জন্য থাকে বিভিন্ন পদ্ধতি বা উপায়। পরিবার এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দায়িত্ব নিয়ে থাকে। প্রত্যেক সমাজে জ্ঞান সরবরাহ-প্রাপ্যতা নির্ধারণের একটা মাপকাঠি থাকে। আমাদের সমাজেও আছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন পরীক্ষা জানান দেয়, একজন শিক্ষার্থী কতটুকু শিখেছে। আর এমন পরীক্ষা পদ্ধতির দ্বারা প্রাথমিকভাবে একজন ছাত্রকে মূল্যায়ন করা গেলেও প্রকৃত মূল্যায়ন অসম্ভব।
মাধ্যমিক স্তরে এসএসসি বা সমমান আর উচ্চ মাধ্যমিকে রয়েছে এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষা। শিক্ষার মান আর ফলাফল যাচাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্তর এই দুটি পরীক্ষা। সারাদেশের মানুষ তাকিয়ে থাকে এই দুটি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আর তাদের ফলাফলের দিকে। এই ফলাফলের উপর একদিকে যেমন নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যৎ; অন্যদিকে স্পষ্ট হয় দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা খুব ভাল বা খুব খারাপ তা বলতে পারব না। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, এক অস্থির অবস্থা। পাঠদান আর মূল্যায়ন পদ্ধতির দ্রুত এবং ঘনঘন পরিবর্তনশীলতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। গত কয়েক বছর ধরে আমরা এই ক্ষতিকর দিকগুলোর প্রভাব দেখতে পাচ্ছি, পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালে এই অবস্থা স্পষ্ট বোঝা যায়।
সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি এখন সর্বত্র আলোচিত। যেখানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল পিছিয়ে কেনÑ এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে, যে যার মতো মন্তব্য করে যাচ্ছে। কেউ বলছে আমরা কি তাহলে পিছিয়ে যাচ্ছি? আবার অনেকে সৃজনশীল পদ্ধতিকে দায়ী করছেন। এছাড়া আবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির অভিযোগও উঠেছে কোথাও কোথাও। সমালোচনার পুরো উল্টাদিকেও আবার কারও কারও অবস্থান স্পষ্ট। শেষ পক্ষের মতামত, আশানুরূপ ফলাফল সবসময় নাও পাওয়া যেতে পারে, তার মানে জিপিএ-৫ অর্জনই মূলকথা নয়। কেউ কেউ আবার বলছেন, এটিই স্বাভাবিক ফলাফল; কারও কারও মত, আরও খারাপ হলেও অস্বাভাবিক কিছু হতো না। ওদিকে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, এবার পরীক্ষার খাতা ভালভাবে দেখা হয়েছে। তাহলে বিগত দিনগুলোতে যে খারাপভাবে দেখা হলো তার দায় কে নেবে? তথাকথিত ভাল ফল করেও ছেলে-মেয়েরা যে ভাল কোথাও ভর্তি হতে না পেরে চরম হতাশাগ্রস্ত হলো তার কৈফিয়ত কি দেবেন মন্ত্রী বাহাদুর। এছাড়া সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকে এমন অনেক কথা বলছেন, যা নীতিবাক্যও বটে। প্রশ্ন হলো, কোন পরীক্ষার ফলাফলে কি পরিমাণ বিপর্যয় বা শতকরা কত ভাগ ফেল করলে তা স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যাবে? এই যে বলা হচ্ছে, জিপিএ বা পয়েন্ট মূল বিষয় নয়। শিক্ষার্থীরা মানুষের মতো মানুষ হলো কিনা এটা মূল বিষয় এতে কারও দ্বিমত নেই, থাকার কথা নয়; কিন্তু দয়া করে বলবেন কি কতটা ভাল মানুষ হলে জিপিএ কম পাওয়া ছাত্ররা দেশের গোটা কয়েক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাবে। কতটা ‘ভাল মানুষ’ হলে পরে লেখাপড়া শেষ করেই ভাল কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ পাবে? যদি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার চেয়ে ভাল মানুষ হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে কেন কম জিপিএ পাওয়ার কারণে ভর্তি বা চাকরির আবেদন করার ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য থাকছে?
যুক্তির কথা হলো, ভাল মানুষ হওয়া যেমন জরুরি ভাল ফলাফল করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পেছনে যেতে রাজি নই। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছরের ফলাফল খারাপ হয়েছে এই সত্যটা মেনে নিয়ে এর যথোপযুক্ত কারণ অনুসন্ধান করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ করা প্রত্যেক সরকারের একান্ত দায়িত্ব, আর শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবশ্যই সরকারকে মনে রাখতে হবে মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প কোথাও নেই। শিক্ষাকে সহজলভ্য করার দিন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শেষ হয়েছে অনেক আগেই। মানের ক্ষেত্রে আপসহীন মনোভাবই প্রমাণ করবে যোগ্যতা। আর প্রতিযোগিতার বিশ্বে যোগ্যরাই রাজত্ব করবে এটাই প্রমাণিত চির সত্য।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: আশিক রহমান