ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভীষ্মের ত্যাগ
া ধিরেন্দ্র নাথ বারুরী
‘মহারাজ শান্তনু ও গঙ্গাদেবীর পুত্র ভীষ্ম ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বীর, মহাপ্রাজ্ঞ, সর্বত্যাগী ও জিতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ। ভীষ্ম পূর্বজন্মে ছিলেন অষ্ট বসুদের একজন। হোমধেনু অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন বলে বশিষ্ঠের শাপে তিনি রাজা শান্তনু এবং দেবী গঙ্গার পুত্র হয়ে জন্মান। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় ভীষ্মই সকলের সামনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য তুলে ধরে শ্রীকৃষ্ণ পূজার প্রবর্তন করেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ১ম থেকে ১০ম দিন পর্যন্ত কৌরবদের সেনাপতি ছিল ভীষ্ম। যুদ্ধের তৃতীয় দিনে ভীষ্মের প্রচ- প্রতাপে পা-বসৈন্যরা ভীত হয়ে পড়ে। শ্রীকৃষ্ণ তার রথ নিয়ে ভীষ্মের সামনে এগিয়ে আসে। কিন্তু অর্জুন পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অনীহা দেখায়। পান্ডবদের শোচনীয় অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথ থেকে নেমে পড়েন।
ক্রোধে রথের চাকা তুলে নিয়ে ভীষ্মের দিকে এগিয়ে যায় শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু, ভীষ্ম অবিচলভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষ্ম জানতেন যে, ‘স্বয়ং ভগবানের হাতে নিহত হলে তার জীবন ধন্য।’ কিন্তু অর্জুনের অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সংযত করেন। ভীষ্মকে বধ করতে না পারলে যুদ্ধে পান্ডবদের জয় সম্ভব নয়, শ্রীকৃষ্ণ এটা জানতেন। তাই শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে, ‘কিভাবে ভীষ্মকে পরাজিত করা যায়’-এটা জানতে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে যায়। ভীষ্ম একান্ত নির্ভয়ে স্বেচ্ছায় বলে দেয় নিজের মৃত্যুর রহস্য। শান্তিস্থাপন ও ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় এইভাবেই নিজের জীবনকে স্বেচ্ছায় বলি দেয় ভীষ্ম।
পরবর্তীতে যুদ্ধের ১০ম দিনে ভীষ্মের কথামতো শিখন্ডীকে সামনে রেখে যুদ্ধ করে অর্জুন। যুদ্ধক্ষেত্রে শিখন্ডীকে দেখে অস্ত্রত্যাগ করে ভীষ্ম। অর্জুনের তীরে তিনি এমনভাবে বিদ্ধ হলেন যে, তার শরীরে দুই আঙুল পরিমাণ স্থানও অবিদীর্ণ ছিল না। কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে শরশয্যায় শায়িত হলো ভীষ্ম। কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে যখন ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত হয় তখন ছিল দক্ষিণায়ন। কিন্তু উত্তরায়ণ ছিল মৃত্যুর জন্য শুভসময়। তাই, ইচ্ছা মৃত্যুর বরে ভীষ্ম উত্তরায়ণ পর্যন্ত প্রতীক্ষা করে থাকে।
তার শরশয্যার ২৮ দিন পর অর্থাৎ ২৯তম দিনে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে যায়। তখন, ভীষ্মের মৃত্যুর ৩০ দিন বাকি ছিল। পরবর্তী ৩০ দিনে দেহত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেয় ভীষ্ম। অবশেষে শরশয্যার ৫৮ দিন পরে মাঘের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভীষ্ম দেহত্যাগ করেন।
মহাভারতে পিতৃভক্ত ভীষ্মের কঠোর প্রতিজ্ঞার জন্য এখনও আমরা সবাই ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’ বলে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ভীষ্মের তিরোধান তিথিতে (ভীষ্মাষ্টমী) আমরা হিন্দুরা তার নামে তর্পণ করে থাকি। যা ‘ভীষ্মতর্পণ’ নামে পরিচিত।
মহাভারতের রাজসূয় যজ্ঞে ভীষ্মই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব ঘোষণা করেছে। বীরভক্ত ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নির্ভয়ে শ্রীকৃষ্ণের আঘাতে মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিল।
ভীষ্মের আদর্শ, ত্যাগ, ধর্মের প্রতি ভালোবাসা এবং কৃষ্ণভক্তি আমাদের অনুপ্রাণিত করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন সেটাই তার পরম গৌরব।