মৃত্যুর আগে যমরাজ পাঠান যে চিঠি
া রবিন কুমার সাহা
পুরাণ মতে মৃত্যুর দেবতা হলেন যমরাজ বা লোকপাল। শাস্ত্রে কথিত হয়েছে, যমরাজই ছিলেম প্রথম মানুষ যিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার এই প্রথমতার কথা মাথায় রেখে শিব তাকে মৃত্যুর অধিপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। মৃত্যুর পরে স্বয়ং যম, অথবা যমদূতেরা এসে পরলোকে নিয়ে যান মৃতব্যক্তির আত্মাকে। জীবদ্দশায় সেই ব্যক্তির কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে মৃত্যুর পরে তার স্থান নরকে হবে নাকি স্বর্গে তা স্থির করেন যমরাজ। শাস্ত্রে কথিত হয়েছে, মৃত্যুর আগেই যমরাজ কোনো মানুষকে চারটি চিঠি পাঠান, যেগুলোতে নিহিত থাকে তার আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণ।
এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে পুরাণোক্ত যম-অমৃতের কাহিনী। একদা যমুনা তীরবর্তী একটি গ্রামে থাকতেন অমৃত নামের এক ঈশ্বরভক্ত মানুষ। তিনি ছিলেন মৃত্যুভয়ে ভীত। তার পরিকল্পনা ছিল, যমকে খুশি করে তিনি অমর হবেন। যমকে সন্তুষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন তিনি। যম তার তপস্যায় খুশি হয়ে দেখা দিলেন।
যম বললেন, ‘শোনো, জীবদ্দশায় আমার দেখা কেউ পায় না। তুমি পেয়েছ। বলো, কী চাও?’ অমৃত বললেন, ‘ঠাকুর, আমি অমর হতে চাই।’ যম বললেন, ‘মৃত্যু থেকে কারও মুক্তি নেই। যে জন্মেছে তাকে মরতে হবেই। তবে তোমার ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে আমি তোমাকে একটি প্রতিশ্রুতি দিলাম। তোমার মৃত্যু যে আসন্ন তা বোঝাতে তোমাকে চারটি চিঠি আমি পাঠাব। সেই চিঠিগুলো পাওয়ার পর তুমি নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করো।’
অমৃত নিশ্চিন্ত হয়ে ধর্মকর্ম সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বিলাসব্যসনে মত্ত জীবনযাপন শুরু করলেন। তার কোনো চিন্তাই রইল না মৃত্যু নিয়ে।
তিনি নিশ্চিন্ত রইলেন যে, মৃত্যুর আগাম ইঙ্গিত যমরাজের কাছ থেকে তিনি নিশ্চয়ই পাবেন। বয়স বাড়তে থাকল তার। একসময় তার মাথার চুল পেকে গেল। আরও পরে দাঁত পড়ে গেল তার। তারপর চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসা শুরু হলো। একসময় বয়সের ভারে একেবারে নিশ্চয় হয়ে গেলেন তিনি। তখনো তার কাছে যমরাজের কোনো চিঠি এসে পৌঁছল না । নিশ্চিন্ত হয়ে দিনযাপন করতে লাগলেন অমৃত।
কিন্তু একদিন রাত্রে হঠাৎ যমদূত এসে হাজির হলো অমৃতের সামনে। তিনি বুঝলেন, তার মৃত্যুর সময় হয়ে গিয়েছে। যমদূতের সঙ্গে তিনি চললেন পরলোকে। মনে তখন যমরাজের প্রতি একরাশ ক্ষোভ তার। যমরাজ তাকে কথা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে চারটি চিঠি পাঠাবেন তাকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি চিঠিও পাঠাননি। যমরাজের সামনে উপনীত হওয়ার পর তিনি উগরে দিলেন তার ক্ষোভÑ ‘আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে চারটি চিঠি পাঠাবেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। কথা রাখেননি আপনি।’ যমরাজ হেসে বললেন, ‘তুমি কি ভেবেছিলে, আমি কাগজের উপরে নিজে হাতে চিঠি লিখে তোমাকে পাঠাব? মূর্খ তুমি। শোনো, তোমার শরীরই ছিল আমার কাগজ, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার শারীরিক পরিবর্তনগুলো ছিল আমার কলম, আর সময় ছিল আমার বার্তাবাহক। আমি তোমাকে আমার কথামতো চারটি চিঠিই পাঠিয়েছিলাম। তোমার চুল পেকে যাওয়ার ঘটনা ছিল আমার প্রথম চিঠি, তোমার দাঁত পড়ে যাওয়ার ঘটনা আমার দ্বিতীয় চিঠি, যখন তোমার দৃষ্টিশক্তি কমে আসা শুরু হলো তখন তুমি পেলে আমার তৃতীয় চিঠি, আর চতুর্থ চিঠিটি তুমি পেয়েছিলে যখন তুমি অচল হয়ে গেলে। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য, তুমি আমার পাঠানো একটি চিঠির পাঠোদ্ধার করতে পারোনি।’
সুতরাং, হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, মৃত্যুর আগে যেকোনো মানুষই এই চারটি চিঠি পেয়ে থাকেন এবং প্রথম চিঠিটি পাওয়ার পর থেকেই নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে। মানবদেহের বয়সোচিত ক্ষয়ই যে তার মৃত্যুর পূর্বাভাসÑ এই সত্যকেই নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করেছে হিন্দু পুরাণের এই কাহিনী।