হিন্দু ধর্ম মানবের ধর্ম
া সনৎ কুমার ঘোষ
হিন্দু ধর্ম মানবের ধর্ম। হিন্দু নাম আমাদের দেওয়া নয়, পরের দেওয়া নাম। সংস্কৃতে এ শব্দটি নেই, কিন্তু এই নাম আমরাও ছাড়তে পারি না। একেবারে চামড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। এর একটি সুন্দর নাম আছে। নামটি হলো ‘সনাতন ধর্ম’।
সনাতন মানে চিরস্থায়ী, চিরকালের ধর্ম। আসল নামটা হলো মনুষ্যত্ব- এটাই মূল ধর্ম। মূল তত্ত্বটাই ‘মানবধর্ম’। প্রাচীন নাম সনাতন ধর্ম- মানব মাত্রেই এটা ধর্ম। আর এ জন্যই এই ধর্মে ‘পড়হাবৎংরড়হ’ নেই। ধর্মে কখনো পড়হাবৎঃ করা যায় না। আপনার মধ্যে যদি মনুষ্যত্ব না থাকে, তবে আপনাকে মনুষ্যত্ব দেবার চেষ্টা করতে হবে। কি করে দেব? উপদেশ আর আদর্শ। আমি নিজে মানুষ হয়ে আপনার সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে আপনি আমাকে দেখে মানুষ হয়ে যাবেন। এই জন্যই হিন্দু ধর্মে পড়হাবৎঃ করার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। যেটা মানব ধর্ম, সেখানে আবার পড়হাবৎংরড়হ কিসের? আপনি মানুষ আপনাকে অপর ধর্মে নেবার কোনো অর্থ হয় না। যে মনুষ্যত্ব অর্জন করেনি, তাকে মনুষ্যত্ব দেবার চেষ্টা করা যায়; মানুষকে মনুষ্যপদ বাচ্য করে তোলবার চেষ্টা করা যায়।
তবে হ্যাঁ, শুধুমাত্র উপদেশ দিয়ে মানুষ গড়া কষ্টকর। চুরি করো না, মিথ্যা বলো না, হিংসা করো না, মানুষ হও, মানুষ হওয়া উচিত- ইত্যাদি উপদেশের সঙ্গে একটি পরম আদর্শের যোগ করে দিতে হয়- যার কাছে যেতে হলে, যার কৃপা পেতে হলে আগে মানুষ হওয়া দরকার। যে চোর, সে তার অনুগ্রহ পায় না। যে মিথ্যাবাদী, তিনি তাকে শাস্তি দেন। এভাবে একটি বড় জিনিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়।
যেমনÑ মানুষকে ভাল করার জন্য পুলিশের ভয়, রাজার ভয়, জেলখানার ভয়- ইত্যাদি ব্যবস্থা সমাজকে রাখতে হয়েছে। তেমনি, মানুষকে মানুষ করার জন্য ভয়, ভালোবাসা, প্রেম, প্রীতি ইত্যাদি মিলিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রাখতে হয়। অর্থাৎ মনুষ্যত্বের সঙ্গে দেবত্বের আলো দেওয়া প্রয়োজন। লক্ষ্যটা মনুষ্যত্ব পর্যন্তই থাকবে না, আরও উপরে লক্ষ্যটি রাখতে হবে, তবেই ঠিক ঠিক মনুষ্যত্ব লাভ হবে। আর তবেই, সার্থক হবে ‘মানবধর্ম’, সার্থক হবে ‘সনাতন ধর্ম’।
মনে রাখতে হবে, সত্য, শিব এবং সুন্দর বলে একটা কিছু আছে। এখন আপনি তাকে ভগবান নাম না দেন, ঈশ্বর নাম না দেন, তাতে ক্ষতি নেই। তাকে আপনি ঢ, ণ, ত বলেন না কেন, কিন্তু তার সঙ্গে জীবনের যোগাযোগ ছাড়া মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিণতি কখনোই সম্ভব নয়। একটা বড় কিছুকে লক্ষ্য করে আমাদের চলতে হবে, সেটাকে আদর্শ রূপে সম্মুখে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
যদি কেউ বলে ভগবান, ঈশ্বর, সত্য শিব সুন্দর বলে কিছু নেই, তাহলে আমরা বলব- না থাক, কিন্তু তাকে ধ্যানে রাখতেই হবে। যেমন- একজন ডাক্তারের ধারণায় থাকতে হবে আদর্শ স্বাস্থ্য কাকে বলে। কোনো রোগ নেই, এমন একজন ব্যাক্তি বাস্তবে খুঁজে না পেলেও, তাকে ধ্যানে রাখতে হবে, যার সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলতে পারবে যে আপনার স্বাস্থ্য কোথায়, কতটুকু ভাল বা মন্দ। কাজেই, একজন ভাল ডাক্তার হতে হলে কোনো রোগ নেই, এমন একটি দেহের অবস্থা ধ্যানে রাখতে হবে। ‘তেমনি যেখানে মিথ্যা নেই, শুধু সত্য, – যেখানে অমঙ্গল নেই, শুধুই মঙ্গল, যেখানে কোনো অসুন্দর নেই শুধুই সুন্দর- এমন একটা জিনিস যদি জগতে নাও থাকে, তবুও আমার ধ্যানে রাখতে হবে, ভাবনায় রাখতে হবে যে, সত্য-স্বরূপ, শিব স্বরূপ এবং পরম সুন্দর কেউ আছেন।’ তাকে ধ্যান করতে হবে এবং সেই ধ্যানই আমার জীবন গড়ে দিবে।
যেমন, প্রত্যেক দেশেরই একটি পতাকা আছে। পতাকায় যাই আঁকা থাক না কেন, তা দেখলেই আপনার মনে দেশপ্রেম জেগে উঠবে। ওটা না থাকলে আপনার দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি হতো কিভাবে? যখনি পতাকাটি তুলে দিল, দেশকে ভালোবাসার একটি পথ পেয়ে গেলেন, না হলে সবই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ছিল। তেমনি, সত্য শিব সুন্দর বলে যদি কিছু নাও থাকে, তবুও তাকে ধরবার জন্য আমাদের মনে মনে একটি পতাকা আঁকতে হবে। যেন এটাই আমার সচ্চিদানন্দ।