যে কারণে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব
া ড. দুলাল ভৌমিক
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমী শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। এদিন তিনি পৃথিবীর ভার মোচনের জন্য অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি পূর্ণাবতার, স্বয়ং ভগবানÑ কৃষ্ণস্তু স্বয়ং ভগবান। পৃথিবীকে ভারমুক্ত করার জন্য এর আগেও তিনি একাধিকবার এসেছিলেন। এ সম্পর্কে গীতায় তার ‘যদা যদা হি সম্ভবামি যুগে যুগে’ উক্তিটি সবারই জানা। কৃষ্ণরূপে জন্ম নিয়ে তিনি শিশু অবস্থায় শিশুঘাতিনী পূতনাকে বধ করেন। একে একে বকাসুর, অঘাসুর এবং আরো অনেক অসুরকে বধ করেন। কৈশোরে বধ করেন মথুরার অত্যাচারী রাজা, তার মাতুল কংসকে, যে নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করেছিল। যৌবনে তিনি মধ্যম পান্ডব ভীমকে দিয়ে বধ করান অত্যাচারী মগধরাজ জরাসন্ধকে। এরপর তিনি নিজে বধ করেন দুর্বৃত্ত চেদিরাজ শিশুপালকে, যে সম্পর্কে ছিল তারই পিশতুত ভাই। এভাবে তিনি একে একে ভারমুক্ত করে পৃথিবীকে সজ্জনের বাসোপযোগী করে তুলছিলেন। কিন্তু এমন সময় সবচেয়ে বড় ভাররূপে আবির্ভূত হয় কুরুরাজ দুর্যোধন, তারই আত্মীয়Ñ পিশতুত ভাই যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুনের জ্যাঠতুত ভাই। তিনি তাকে অনেক বুঝিয়েছেন, আত্মশুদ্ধির অনেক সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী’, ‘অঙ্গারঃ শতধৌতেন মালিন্যং ন মুঞ্চতি’। তাই ভারতযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরব ও পান্ডবরা মুখোমুখি। অর্জুন সারথি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, রথটা উভয় সেনাদলের মাঝখানে নিয়ে যেতে। কারণ তিনি দেখতে চান অপরপক্ষে যুদ্ধের জন্য কারা উপস্থিত হয়েছেন। তিনি দেখলেন, ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ একান্ত আপনজনেরা উপস্থিত। যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে অর্জুনকে এদের হত্যা করতে হবে। তার বুক কেঁপে উঠল। তিনি তীরধনু ফেলে রথের ওপর বসে পড়লেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন যুদ্ধ করবেন না। স্বজনদের হত্যা করে রাজ্যলাভে তার প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে ভিক্ষা করে কিংবা বনের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণও অনেক ভালো। তখন ভগবান গর্জে উঠলেন, হে অর্জুন! এরূপ পৌরুষহীনতা তোমাতে শোভা পায় না; তুমি ক্ষত্রিয়, তাই হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও, যুদ্ধ করো।
এরপর ভগবান অর্জুনকে আরো তীব্র আঘাত করলেন। তিনি বললেন, ‘স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি। ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়ো ন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে’Ñ হে অর্জুন! তুমি যদি তোমার নিজের ধর্মের কথাও চিন্তা করো, তাহলেও তোমার কম্পিত হওয়া উচিত নয়, কারণ ধর্মযুদ্ধ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের অন্য কোনো শ্রেষ্ঠ কাজ নেই। লক্ষ্যণীয় যে, ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, ভগবান এখানে তা বোঝাননি। তিনি ধর্ম বলতে বুঝিয়েছেন যার যার পেশাকে। তার মতে নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করাই ধর্ম। সে মতে অধ্যাপকের ধর্ম অধ্যাপনা, ছাত্রের ধর্ম অধ্যয়ন, কৃষকের ধর্ম কৃষিকাজ ইত্যাদি। এই ধর্ম পালনে যে ব্যর্থ হয়, তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। আগুনের ধর্ম উষ্ণতা। উষ্ণতা হারালে আগুন আর আগুন থাকে না। জলের ধর্ম তরলতা। তারল্য হারালে জল আর জল থাকে না। তেমনি ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রধর্ম হারালে সে আর ক্ষত্রিয় থাকে না। অর্থাৎ, পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলোা বিপর্যয় ডেকে আনে।
এ প্রসঙ্গে ভগবান আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ’Ñ নিজের ধর্ম যেমনই হোক তা পরের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; স্বধর্মে নিধনও ভালো, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ। এর অর্থÑ আমার যে পেশা, আমার বিজ্ঞতা সেখানেই; সেটা ছেড়ে অন্যের পেশায় হাত লাগালে দুটোই বিপর্যস্ত হবে, এটাই অধর্ম। শ্রীকৃষ্ণের এ উপদেশ কেবল অর্জুনের ক্ষেত্রেই নয়, সর্বকালের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্যÑ ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণি নির্বিশেষে। পারমার্থিক জীবনের কথা বাদই দিলাম, জাগতিক জীবনেই এ উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনীয়। ভগবানের এসব উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করে অর্জুনের মোহ কেটে যায়। সব রকমের দৌর্বল্য পরিহার করে তিনি যুদ্ধে ব্রতী হন। দুর্যোধনাদি দুষ্কৃতিকারীরা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবী ভারমুক্ত হয়। ব্যষ্টি নয়, সমষ্টি আনন্দ লাভ করে। ভগবান কার্য সমাপনান্তে স্বস্থানে গমন করেন। লেখক:, অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়