‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অ্যান্ড জজ হ্যারিসন
রাহাত মিনহাজ
বিশ্ব সভ্যতায় গত শতাব্দীর ৬০-এর দশক ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। এ সময় পিপলস্ ভয়েসকে শুনতে বাধ্য হয়েছে বিশ্বের পরাশক্তি বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধকে সামনে রেখে অভূতপূর্ব এক প্রতিবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ যুবসমাজ। এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যান্ড ছিল ‘বিটলস্’। যার জন্ম যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে ১৯৬০ সালে। এই ব্যান্ডের চারজন সদস্যÑ জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, রিংগো স্টার ও জর্জ হ্যারিসন সারাবিশ্বে তখন তুমুল জনপ্রিয়। ৬০-এর দশকে তারা বিশ্ব সঙ্গীতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তবে তাদের মধ্যেও ভাঙন দেখা দেয়। আলাদা হয়ে যান সদস্যরা। তবে ১৯৭১ সালে জর্জ হ্যারিসনের আমন্ত্রণে তারা আবার একত্রিত হন। গান গান বাংলাদেশ নামক একটি যুদ্ধরত দেশের জন্য। যে দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার নিরন্ন মানুষ প্রাণ দিচ্ছিল। যে দেশে রক্ত, কাদা আর মৃত্যু একাকার ছিল দিনের পর দিন। সেই দেশটির নাম বাংলাদেশ। যার জন্য ছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ধারণাটি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী প-িত রবি শঙ্করের। রবি শঙ্কর খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের দুর্দশা দেখেছেন। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে মানবিক বিপর্যয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় কেঁদেছে অনেক আগে থেকেই। ১৯৭১ সালে বিটলস্ এর জর্জ হ্যারিসন রবি শঙ্করের কাছে সেতার বাজানো শিখছিলেন। দীর্ঘ তিন বছর ধরে হ্যারিসন রবি শঙ্করের সেতারের শিক্ষার্থী ছিলেন। রবি শঙ্কর একটা কনসার্ট করার কথা প্রথম বলেছিলেন তার ছাত্র জর্জ হ্যারিসনকেই। হ্যারিসন এতে খুবই আগ্রহ বোধ করেন। সঙ্গে অভিমান ভুলে যোগাযোগ শুরু করেন পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ব মাতিয়েছে বিটলস্। মানবিক এই আবেদনে সাড়া দেয় বিটলস্ এর অন্য সদস্যরা।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের চ্যারিটি এই কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। বহুল আলোচিত এই কনসার্ট নিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয় সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের ছিল ব্যাপক আগ্রহ। প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল কনসার্ট হবে এক দফায়। দুপুরের পর শুরু হলে চলবে তিন ঘণ্টা। পরে দর্শক শ্রোতাদের প্রবল আকর্ষণে এই কনসার্ট দুই দফায় নেওয়া হয়। প্রবল আগ্রহ আর আবেগে মানুষ গান শোনেন এই জাতির জন্মলগ্নের প্রতীক্ষায়। কনসার্টের শুরুতে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন জর্জ হ্যারিসন। এরপর ভারতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় কনসার্ট। বাংলা ধুন বাজান প-িত রবি শঙ্কর ও আল্লারাখা রহমান। এরপর একে একে মঞ্চ মাতান এরিক ক্লাপটন, বব ডিলান, লিওন রাসেলসহ অন্যান্যরা। ৪০ হাজার মানুষ উপভোগ করেন কনসার্ট। যার শেষে জর্জ হ্যারিসন গান ‘বাংলাদেশে, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ…’ গানটি। এই গানটি এই বিশেষ বিশেষত্ব আছে। জর্জ হ্যারিসন এই গানটি লিখেছিলেন একেবারে বাস্তব ঘটনাটি বর্ণনা করে। প-িত রবি শঙ্কর আর্তমানবতার দাবি নিয়ে গিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসনের কাছে। এদিকে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে এ্যান্থনী মাসকারেনহাস বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। কলেরাতে মানুষ মরছে প্রতিদিন। মার্কিন কূটনীতিক আর্চাড কেন্ট ব্লাডের টেলিগ্রাম আলোড়ন তুলেছে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। এ সবকিছু মাথায় রেখেই জর্জ হ্যারিসন লিখেন বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। পিয়ানো বসে মাত্র ১০ মিনিটে গানটির ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিলেন কালজয়ী এই শিল্পী। পরে যা আরও শুদ্ধরূপে উপস্থান করেন বিশ্ববাসীর সামনে। যাতে ছিল আকুতি মানবতার পক্ষে। জর্জ হ্যারিসন গেয়েছেন ‘মাই ফ্রেন্ড কেম টু মি ইউথ স্যাডনেস ইন হিস আইয়েস, টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়াসেবটড হেল্প ফর হিস কান্ট্রি ডাইয়েস্। অলদো আই কুড নট ফিল দ্যা পেইন, আই নিইউ আই হ্যাড টু ট্রাই, নাউ আই এ্যাম আসকিং অল অফ ইউ টু হেল্প আস সেভ সাম লাইভস্। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, হোয়ার সো মেনি পিপল ডাইয়িং ফাস্ট অ্যান্ড ইট শিউর লুকস লাইক এ মেস, আই হ্যাভ নেভার সিন সাচ ডিসট্রেচ, নাউ ওন্ট ইউ লেন্ট ইউর হ্যান্ড, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, রিলিভ ইন পিপল অফ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।’ ঐতিহাসিক এই কনসার্ট থেকে আয়োজকরা ২০ হাজার ডলার তোলার আসা করেছিলেন। কিন্তু মানবতার অভূতপূর্ব সাড়ায় আয় হয় আড়াই লাখ ডলার। যা ইউনিসেফের মাধ্যমে পাঠানো হয় দুর্গতদের কাছে। আর বিশ্ব দরবারে মানবতার জন্য বেনিফিট কনসার্ট হিসেবে অমর হয়ে যায় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ও এই কনসার্টের শিল্পী আর সহযোগিরা। শ্রদ্ধা সেই সময়ের ওইসব মহাপ্রাণ শিল্পীদের যাদের হাতে বাদ্যযন্ত্র বেজেছিল রাইফেলের মতো।
লেখক: প্রভাষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান