ধর্ষণের অন্তরালে…
শেখ মিরাজুল ইসলাম
পুরুষ কেন ধর্ষণকামী হয়ে ওঠে? এই প্রশ্ন ঘিরে বহুমাত্রিক আলোচনা-গবেষণা যথাক্রমে সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ন্যায় শাস্ত্রের আলোকে চলমান থাকলেও এর যথাযথ উপযুক্ত বিচার না হওয়ার প্রেক্ষিতে অপরাধটির বিস্তার ঘটছে, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। তারপরও একজন ধর্ষক স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একই অপরাধে প্ররোচিত হয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যক্তিগত উস্কানিতে ধর্ষণে লিপ্ত হচ্ছে। বিকৃত আনন্দ বা প্রতিশোধÑ যেভাবেই সেটা দেখা হোক না কেন।
হলিউডি রূপালী পর্দায় গুণী পরিচালক বার্তালুচি বা অভিনেত্রী মনিকা বেলুচির উচ্চমার্গীয় চলচ্চিত্রে শারীরিক আবেগঘণ মুহূর্ত কিংবা হিন্দি সিনেমায় সানি-হাশেমীর রগরগে যৌন দৃশ্য অথবা ঢালিউডে মৌসুমী-রুবেলের উত্তেজক গানের দৃশ্য দেখেও কারও কারও ভেতর ‘সম্ভাবনাময় ধর্ষক’ প্রবৃত্তি জেগে উঠতে পারে। হাতের কাছে সহজে পাওয়া অন্তর্জালের দুনিয়ায় বিভিন্ন ঘরাণার পর্নো ছবির সহজলভ্যতার কথা নেই বা উল্লেখ করলাম। নিজের অবদমিত শারীরিক চাহিদা মেটাতে সেই ধর্ষকাম ব্যক্তি অসহায়, অবলা নারী বা শিশুকে দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করবে কি করবে না, তা অনেকটা শ্রোডিংগারের বিড়ালের মতো সম্ভব ও অসম্ভবের পে-ুলামের কাঁটায় দুলতে থাকে। ধর্ম, পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ কোনোকিছুই একজন ধর্ষকের অন্তদর্শনে প্রভাব ফেলে না। গত এক বছরে ঘটে যাওয়া আলোচিত ধর্ষণ কা-গুলো জরিপ করলে এর সত্যতা বোঝা যাবে। বনানীর উঁচুতলা থেকে বগুড়ার মফস্বল এলাকা, গ্রামের পাট ক্ষেত থেকে নদীর ঘাট, চলন্ত বাস হতে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ কোথাও ধর্ষক পুরুষের হাত হতে নারীদের নিস্তার মেলেনি। ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধর্ষকদের মানসিক প্রবৃদ্ধির উদহারণও যথেষ্ট। পাশাপাশি একক বা দলবদ্ধ ধর্ষণের মূলে লুকিয়ে আছে সাধারণ অপরাধ প্রবণতার বিকৃত উন্মেষ। একইসঙ্গে ক্ষমতা বা সামাজিক শক্তি তার বিচারিক প্রক্রিয়া রুদ্ধ করবার গোপন শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে ক্ষমতাবানরা এই অপরাধে উদ্বুদ্ধ হয় সবচেয়ে বেশি। এই বাস্তবতা শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশের ক্ষমতাবানদের জন্য প্রযোজ্য। পাকিস্তানের পাঞ্জাব, দিল্লির রাজপথ কিংবা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল প্রতি ক্ষেত্রে ধর্ষণের আলামত নষ্ট করবার বা অপরাধকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবার নিয়ামক-শক্তি সমাজে সক্রিয় থাকায় যেকোনো ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করা হলেও তার প্রতিক্রিয়া পরবর্তী ধর্ষকের মধ্যে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না। ধর্ষক থাকে যথারীতি দুর্বিনীত ও নির্লিপ্ত।
সেই ১২৭৫ সালে ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনিস্টারে আইন প্রণীত হয়েছিল ধর্ষকের শাস্তি হবে দুই বছরের কারাদ-। পরবর্তীতে ১২৮৫ সালে নতুন আইনি সুপারিশে তা মৃত্যুদ-ে কার্যকর করা হয়েছিল। কিন্তু ধর্ষণ ঠেকানো যায়নি। ১৮৩৮ সালে নিউইয়র্কে এক আইনি লড়াইয়ে সর্বপ্রথম জনৈকা ধর্ষিতাকে আদালতে প্রমাণ দিতে হয়েছিল তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ধর্ষককে ঠেকাতে চেয়েছিলেন। যেটি আইনবেত্তাদের কাছে ‘পিপল ভার্সেস অ্যাবট’ মামলা নামে পরিচিতি পেয়েছে। এভাবে সময়ে সময়ে এগিয়েছে এই সংক্রান্ত আইন। কিন্তু বারবার এই অপরাধ ঘটে চলেছে, ঠেকানো যায়নি। কারণ ধর্ষণ আইন কার্যকরের আগা-গোড়া পুরো জায়গাজুড়ে পুরুষতান্ত্রিকতার লেবাস অনেক শক্ত। সেই অবস্থান থেকে নারীর প্রতি অব্যাহত সহিংসতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর উইম্যান’ নামের সংগঠনটি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতার সুবিচার পাওয়া এর মাধ্যমে সহজ হলেও আমাদের আটপৌরে সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা তুফান সরকারদের মতো সামাজিক কীট-পতঙ্গদের মূলোৎপাটন করা এখনো সময়ের ব্যাপার। ১৫৬২ সালে শিল্পী তিশিয়ান পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে এঁকেছিলেন ‘ধর্ষিতা ইউরোপা’ শিরোনামের বিখ্যাত চিত্রকর্মটি। আজ একবিংশ শতাব্দীতে পত্রিকার পাতায় শোভা পায় ধর্ষণের বিচার চাওয়া ন্যাড়া মাথায় মা-মেয়ের করুণ চিত্র। বোঝাই যায়, এই আদিম অপরাধের শিকড় হাজার বছরের পুরনো। নারী ‘না’ বললেও কোনো কোনো পুরুষ তা শুনবে না। এই রিপুর প্রবণতা উৎপাটন করা আপাত দুরূহ হলেও প্রচলিত আইনের আমূল সংস্কার করা ছাড়া এই অপরাধ প্রতিরোধের বিকল্প নেই। ধর্ষক ও ধর্ষিতা উভয় পক্ষে যারা আইনি লড়াই চালান তারা নিজেরাও বোঝেন, নরম সূতোর নাটাই হাতে ঝড়ো বাতাসে বেশিক্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো যায় না।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান