ওয়াদা, আমরা এবং ইসলামের নির্দেশ
মাহফুজ আল মাদানী
ওয়াদা। অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি। ইংরেজিতে চৎড়সরংব, ঈড়সসরঃসবহঃ বলে। পরিভাষায় ‘কোনো কথা কাজ বা বস্তু প্রদান বা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার করাকে ওয়াদা বলে’। অথবা ‘কারও সঙ্গে মৌখিকভাবে বা লিখিতখভাবে চুক্তি করা বা কথা দেওয়াকে ওয়াদা, অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি বলে’। ওয়াদা রক্ষা করা ইসলামি শরিয়তে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ওয়াদা পূরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর’ -(সুরা আল মায়িদা: ০১)। ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে সমাজে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হয়। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করা আবশ্যক। ওয়াদা ভঙ্গ করাকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকদের আলামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াদা ভঙ্গ করাকে মুনাফিকের নিদর্শন হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘(মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য সমূহের একটি হলো) যখন সে ওয়াদা করে, তখন সে তা ভঙ্গ করে’ -(বুখারি, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, নাসায়ী, বায়হাকী, ইবনে হিব্বান, দারে ক্বুতনী, ইবনে আবু শাইবা, শরহে সুন্নাহ)।
ইসলামি শরিয়তে ওয়াদা পরিপূর্ণ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ওয়াদা পরিপূর্ণ করা ব্যক্তির ধার্মিকতার পরিচায়ক। কেননা, যে ওয়াদা পূর্ণ করে না তার ধার্মিকতা পরিপূর্ণ হয় না। হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী, ‘যে ব্যক্তি অঙ্গীকার পূর্ণ করে না তার দীনদারি নেই’-(আহমদ)। ওয়াদা পালন বা অঙ্গীকার পূরণ করা ইমানের অঙ্গ। তা ভঙ্গ করা জায়েয নেই। ওয়াদা পূর্ণ করার গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে’ -(সুরা আল ইসরা: ৩৪)। কারও সঙ্গে অঙ্গীকার করার পর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এ ভঙ্গ করার কারণে কোনো নির্দিষ্ট কাফফারা দিতে হয় না, বরং পরকালে শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন অঙ্গীকার ভঙ্গকারীর পিঠে একটি পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হবে, যা হাশরের মাঠে তার অপমানের কারণ হবে’। হজরত ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-সহ অধিকাংশ ইমামগণের মতে, ওয়াদা পালন করা মুস্তাহাব, আর ভঙ্গ করা মাকরূহ। তবে হজরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) সহ কতিপয় আলেমগণের মতানুসারে ওয়াদা রক্ষা করা ওয়াজিব। হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী, ‘হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, যখন কোনো লোক তার ভাইয়ের সঙ্গে ওয়াদা করে এবং তার নিয়ত থাকে যে, সে ওয়াদা পালন করবে। কিন্তু সে (কোনো কারণ বশত) তা পালন করল না এবং ওয়াদা মোতাবেক যথাসময়ে আসল না। তাহলে তার কোনো গোনাহ হবে না’ -(আবু দাউদ, তিরমিজি)।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াদা করে কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেননি। বরং ওয়াদা পরিপূর্ণ করার জন্য প্রাণাদিক চেষ্টা করতেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু হাসমা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে তার নবুয়ত প্রাপ্তির আগে বেচা-কেনা করেছিলাম। যার কিছু মূল্য বাকি রয়ে গিয়েছিল। আমি তার সঙ্গে ওয়াদা করেছিলাম যে, নির্দিষ্ট একটি স্থানে বাকি মূল্য নিয়ে উপস্থিত হব। আমি তা ভুলে গেলাম। তিনদিন পরে আমার স্মরণ হলো। (এসে দেখলাম) তখনো তিনি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষমান আছেন। (আমাকে দেখে) তিনি বললেন, তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ। আমি এখানে তিনদিন যাবত তোমার অপেক্ষা করছি’ -(আবু দাউদ)। যা থেকে স্পষ্ট হয় যে, আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াদা পূরণে কতটুকু সচেষ্ট ছিলেন। তাই আমাদেরকেও তার অনুসরণ করে ওয়াদা প্রতিপালনে অগ্রবর্তী হতে হবে। তিনিই আমাদের উত্তম আদর্শ।
আমাদের সমাজে অঙ্গীকার করে পূর্ণ না করার অহরহ উদাহরণ বিদ্যমান। জনগণকে নির্বাচনি সময়ে নানাবিধ অঙ্গীকার ও প্রলোভন দেখিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে ধোঁকা দিয়ে অঙ্গীকারকে মাটিতে মিশিয়ে দেন। শুধু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী নন, সাধারণ মানুষজনও ওয়াদা পূরণে অনেক গাফলতি করেন। যা মোটেও সমীচীন নয়। তাছাড়া আমাদের সমাজের অনেক সম্মানিত লোকও আছেন যারা ওয়াদা করে তা পূর্ণ করেন না। অথচ প্রবাদে রয়েছে, ‘সম্মানিত লোক ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করেন’। আমরা আমাদের কৃত অঙ্গীকারসমূহ যথাযথভাবে পরিপূর্ণ করতে পারলে সমাজে লোকদের নাভিশ্বাস হতো না। সমাজ আরও এগিয়ে যেত কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। আসুন সমাজকে এগিয়ে নিতে কৃত অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দিই। ওয়াদা পূরণ করতে ওয়াদাবদ্ধ হই। ওয়াদা ভঙ্গ করতে নয়।
লেখক: এম. ফিল গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান