ড. হ্যান্স হার্ডার, বাংলাভাষা চর্চা এবং আমার জার্মান দর্শন
তিন. ৪ জুলাই ছিল আমার প্রথম বক্তৃতা। এটি ছিল ইউরোপের কোনো দেশে ইংরেজিতে প্রথম উপস্থাপনা। সকালে চৈতী বসু হোটেল থেকে বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলেন আমাকে। হাইডেলবার্গ শহরের ইরংসধৎপশঢ়ষধঃু থেকে সহজেই সেখানে আমরা পৌঁছে গেলাম। ঘুরে দেখছিলাম ‘সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটে’র পুরো ভবনটি। ওদের ওয়েবপেজে আমার বক্তৃতার বিষয় ও সময় জানিয়ে পোস্টার দেওয়া হয়েছে। পরিচয় হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. রাহুল মুখার্জির সঙ্গে। অবশ্যই মিয়া মুস্তাফিজের মাধ্যমে। কলকাতার রাহুল মুখার্জির বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি আমেরিকা, সিঙ্গাপুর ও দিল্লিতে শিক্ষকতা শেষে এখানে এসে শেষ ঠিকানা গড়েছেন। আমার বক্তৃতায় উপস্থিত থাকতে না পারলেও ৬ জুলাই আমাকে দুপুরের আহার করাতে ক্যান্টিনে নিয়ে গেছেন এবং অনেকটা সময় দেশ-বিদেশের নানা প্রসঙ্গ আলোচনা করেছি তার সঙ্গে। অবশ্য প্রথমদিন আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বিশেষত হিন্দি, উর্দু ভাষায় অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সঙ্গে কিংবা ছাত্র-ছাত্রী যারা নিবেদিত জ্ঞান চর্চায় তাদের সঙ্গে সময় কেটেছে। অবশ্যই সকলের মধ্যমণি ছিলেন ড. হ্যান্স হার্ডার। প্রথমদিন বক্তৃতার আগে দুপুরে তিনি বেশ কয়েকজন শিক্ষকসহ আমাকে দুপুরের খাবার খাইয়েছেন। দেখিয়েছেন তদের অফিস ও ক্লাস রুম। বিকাল চারটায় চৈতী বসু ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাদল সরকারের একটি নাটকের রিহার্সেল করছিলেন সেখানেও কিছুক্ষণ থেকেছি। বাংলা ছোটগল্পে ডাইনি চরিত্র নিয়ে ইংরেজিতে বক্তৃতার পর সেখানকার কয়েকজন শিক্ষকের প্রশ্ন আমাকে উদ্দীপিত করেছে। বুঝলাম এখানকার প্রত্যেকেই মনোযোগী শ্রোতা।
৫ তারিখে বাংলাদেশে জার্মান সাহিত্য চর্চা নিয়ে কথা বললাম। হ্যান্স বললেন, তদের কাছে অনেক নতুন বিষয় উন্মোচিত হলো। কারণ তরা জানলেও সব খবর রাখতে পারেননি। অনেককিছুই অজানা ছিল। আমি স্বীকার করলাম জার্মান ভাষা জানা থাকলে এই কাজটি পরিপূর্ণ হতো আরও। দুদিনের দুটি বক্তৃতা আমার শিক্ষকতা জীবনের অনেক বড় সঞ্চয়। তাছাড়া জার্মানিতে বাংলা ভাষা শেখার জন্য নিবেদিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আলাপচারিতাই জানলাম অধ্যাপক হ্যান্স বাংলা সাহিত্যে অতিপ্রাকৃতের ব্যবহার নিয়ে কাজ করছেন। অন্যদিকে চৈতী বসুও নতুন কাজে হাত দিয়েছেন। তরা দুজন পরিশ্রম করে শিক্ষার্থীদের তৈরি করছেন। বাংলা ভাষী অঞ্চলে বা দেশে পাঠিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট রয়েছেন। দেখলাম সেখানকার ছেলে-মেয়েরা চাকরির জন্য কিংবা সার্টিফিকেট নেবার জন্য লেখাপড়া করে না। বরং শিখতে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে এটাই তাদের মূল লক্ষ্য।
চার. জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেওয়া এবং সেখানকার বাংলা ভাষা চর্চার পরিবেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন অবশ্যই আমার জীবনে অনেক বড় ঘটনা।
বিশেষত হাইডেলবার্গে ভ্রমণ করে নতুন সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানার ?সুযোগ পেয়েছি। এজন্য আমি প্রথমেই অধ্যাপক ড. হ্যান্স হার্ডারকে ধন্যবাদ জানাই। তিনিই আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান স্যার। আর সেখানে পৌঁছানোর পর চৈতী বসু যে সময় দিয়েছেন তার মূল্যও অনেক। অবশ্যই মনে থাকবে ৬ জুলাই ড. হ্যান্সের সঙ্গে ল্যাডেনবার্গে নেকার নদীর তীরে মধ্যযুগের অপূর্ব শহরটিতে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি। সেখানে বসে রোমান সা¤্রাজ্যের নির্মাণ শৈলিতে তৈরি ভবনগুলোর স্মৃতিকথা ভেসে ওঠার সময় আর বেয়ারের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে মার্কেট স্কয়ারের চারপাশের পরিবেশের কথা কখনো ভুলব না। যে জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনবার ভ্রমণ করেছিলেন সেই দেশটিতে আমি একবার গিয়েই মুগ্ধ হয়েছি। সুযোগ পেলে ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে রইল আবার। কারণ ড. হ্যান্স হার্ডারের মতো নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিরা সেখানে বাংলাভাষার চর্চা ও গবেষণা করছেন। (সমাপ্ত)
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, গণসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান