হজ : বিশ্ব মুসলিমদের ঐক্যের সেতুবন্ধন
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
হজ শব্দটি আরবি। অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, মহান বস্তুর ইচ্ছা পোষণ করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় ইসলামের মহান একটি রুকন আদায় করার নিমিত্ত পবিত্র কাবা ঘরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করাকে হজ বলা হয়। মোট কথা, হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কাবা পরিদর্শন। আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কাবা শরীফে তাওয়াফ এবং মদিনা মনোয়ারা জিয়ারত অবশ্য কর্তব্য। হজের প্রথম তাৎপর্য হচ্ছে, এটি সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের এমন এক মহা সমাবেশ যেখানে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার-আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্র বিন্দুতে এসে সমবেত হন। সকলেরই লক্ষ্য বিশ্ব মানবের প্রথম উপাসনা কেন্দ্র কাবার জেয়ারত, সবার মুখে একই ভাষার একটি মাত্র বাক্য “ লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক” যার বাংলা অর্থ, হাজির হয়েছি ওগো আল্লাহ! হাজির হয়েছি! এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য এসেছি। আমার সকল কিছু তোমার কাছে সমর্পণ করতে এসেছি।
তাই বলতে হয়, হজ্বের এ সফরে অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়, কোনো লক্ষ্য নয়, কোনো পার্থিব স্বার্থের আকর্ষণ নয়, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহর নির্দেশে সমগ্র বিশ্বমানবকে আপন করে পাওয়ার আকুতিটুকুই একান্ত কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হৃদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের সেতু বন্ধন। হজের বাৎসরিক সমাবেশ সে ঘরের জেয়ারত, সে ঘরের তাওয়াফ, স্মরণীয় সে ময়দানে গিয়ে অবস্থান যেখানে দীর্ঘ বিরহ-যাতনা ভোগ করার পর আমাদের প্রথম মা-বাবা এসে পুনর্মিলিত হয়েছিলেন, প্রাণভরে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। মুক্তি এবং শান্তিধারা প্রাপ্তির আশ্বাস প্রাপ্ত হয়ে পূর্ণ প্রশান্তিতে রাত যাপন করেছিলেন। কয়েক দিনের হজ্বের সফর প্রতিটি হজ্বযাত্রীকে নিয়ে যায় মানুষের এ জন্ম প্রবাহ শুরুর সেই আদি দিনগুলোতে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে হজ অন্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। শারীরিক , মানসিক এবং আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থ্যবান লোকজন হজ করতে যাবেন এটাই প্রত্যাশিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকেও কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা শরীফে হজ ও মদীনা শরীফ জেয়ারত করতে যান। হজের প্রধান শিক্ষাই হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব মানবের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সেতু বন্ধন তৈরি করা এবং ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ব্রতী হওয়া। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ হজ্বের ভাষণের মধ্যে এ শিক্ষাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে প্রদান করেছেন এবং উদাত্ত্বকন্ঠে তিনি আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, “লোক সকল, তোমাদের সকলের প্রভু এক, তোমাদের সকলের আদি পিতাও এক ব্যক্তি। সুতরাং কোনো আরব অনারবের উপর, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গের উপর কিংবা কোনো কৃষ্ণঙ্গের উপর কোনো শ্বেতাঙ্গের জন্মগত কোনো প্রাধান্য নেই। সম্মান যোগ্য হবে সে ব্যক্তি যে একনিষ্ঠ খোদাভীরু। মনে রেখো, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, আর বিশ্বের সকল জনগোষ্ঠী মিলে এক মহাজাতি।
হজের মধ্যে উদ্দেশ্যের ঐক্য, পোষাকের ঐক্য, ভাষার ঐক্য এবং লক্ষ্যের ঐক্য বজায় রাখার তাগিদ এবং তৎসহ মূল লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার মত সবকিছু থেকে দূরে থাকার তাগিদ ও কোরআনে সুষ্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। যেমন “হজ্বের সফরে অশোভন বা কেনো অন্যায় আচরণ আর ঝগড়া বিবাদ যেন না হয়।’ হাদীস শরীফের ভাষায় “তোমরা পরস্পর বিদ্ধেষ পোষণ করো না, একে অন্যের মর্যাদা হানির চেষ্টা করো না। অন্যায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না। মহান আল্লাহর সকল অনুগত ব্যক্তি মিলে ভাই-ভাই হয়ে বাস করো।
মানুষের অন্তরে তার জন্মগত ঐক্যের অনুভূতি দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যেই পারস্পরিক কতগুলো প্রক্রিয়া অত্যাবশক করে দেওয়া হয়েছে।
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে সমবেত হওয়া, সপ্তাহে জুম্মার দিন এবং বছরে দু’বার বৃহত্তম সমাবেশ দুই ঈদের জামাতে গিয়ে হাজির হওয়া আবশ্যক। হজ্বের সর্ববৃহৎ সমাবেশ সে ধরনের একটা বিশ্ব সম্মেলন। তাই বিশ্বজনীন এ অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষাই হচ্ছে হজের প্রধান শিক্ষা। আমরা কামনা করি এবারের হজ যেন বিশ্ব মুসলিমের জন্য সেতুবন্ধন তথা একতা, ঐক্য ও সহযোগিতামূলক হয়। আর এ শিক্ষায় যদি আমরা উজ্জীবিত হতে পারি তাহলেই সফল হব আমরা। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সবাইকে হজের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করে সঠিক ভাবে হজ পালনের তাওফিক দান করেন।