প্রধান বিচারপতির বাণী চিরন্তনী
শেখ মিরাজুল ইসলাম
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি তার পর্যবেক্ষণে নতুন কিছু বলেননি। যা বলেছেন তা আদতে নিরীহ শান্তিপ্রিয় আমজনতাদের মনের কথা। পত্রিকান্তরে বলা হচ্ছেÑ এর ফলে নাকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার অস্বস্তি ও চাপের মধ্যে পড়েছে। বিরোধী দলীয় মানসিকতা নিয়ে পর্যালোচনা করলে কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু আজ যদি বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকত তবে এই বিষয়টি তাদেরও ক্ষমতা ভোগ-উপভোগের পথে কাঁটার মতো বিঁধত। তবে বিএনপি এই ইস্যুতে গলা উঁচু করতেই পারে, কারণ এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ষোড়শ সংশোধনীর দায়ভার থেকে আপাতত মুক্ত তারা।
প্রধান বিচারপতি রায়ে তার সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণের মধ্যে বলেছেন, ‘মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা আর প্রযুক্তির উন্নতির সহায়তা নিয়ে অপরাধের প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাহী বিভাগ আরও অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং আর আমলাতন্ত্র দক্ষতা অর্জনে চেষ্টাহীন।’ প্রধান বিচারপতি আরও উল্লেখ করেন, ‘এই সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মুখে বিচারবিভাগই তুলনামূলকভাবে স্বাধীন অঙ্গ হিসেবে কাজ করছে, ডুবতে ডুবতে নাক উঁচিয়ে বেঁচে থাকার মতো। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিচারবিভাগও খুব বেশিদিন টিকে থাকবে না। এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতের বিচারকদের নির্বাচন ও নিয়োগের কোনো আইন হলো না। নির্বাহী বিভাগ বিচারবিভাগের ক্ষমতা সংকুচিত করতে আগ্রহী। আর যদি তা হয় তাহলে এর চেয়ে ধ্বংসাত্মক আর কিছু হবে না।’
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি বলেছেন তা হলোÑ ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন, কোনো ক্ষমতাধর দৈত্যের জন্য নয়।’ বাস্তবিক অর্থে এই চিরন্তন বাণীটি সোনার হরফে লিখে রাখার সময় হয়ে এসেছে। আমাদের বিশ্বাস, ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়টি একটি ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দলিল হিসেবে টিকে থাকবে। এতে আওয়ামী সরকারের গাল ভারি করে অভিমান করার কিছুই নেই। এর কৃতিত্বের অংশীদার তারাও। বিচারপতিকে তারা বাধাহীনভাবে নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটুকু অন্তত দিয়েছেন।
তাই বিচারপতি যখন ‘একমাত্র বিচারবিভাগই অপেক্ষাকৃত স্বাধীন, যদিও তা ডোবার পথে…’ কথাটি বলেন, তখন আমাদের চোখে অতিবৃষ্টি বা বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া পথ ঘাট-জনপদের দৃশ্য ভেসে ওঠে না। আমরা তার কথায় আইনের শাসনের প্রতি ইঙ্গিতকেই বুঝি। যার প্রভাবক ও অভিভাবকত্বের দায় কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক সরকারের উপর বর্তায়।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান