নারীবাদ ও তার অ-গ্রহণযোগ্যতা
আমেনা বেগম
ফেসবুকে বা অনলাইনে লেখালেখির একটা বড় অংশ হচ্ছে নারী বিষয়ক কথাবার্তা। অথবা আমি মেয়ে বলেই হয়তো মেয়েদের কথাবার্তা বেশি চোখে পড়ে। এসব আলাপের বিভিন্ন ভেরিয়েশন আছে। ইসলাম ধর্মের বাহাত্তর কাতারের মতো নারী বিষয়ক কথাবার্তায় ও নানামুনির নানা বক্তব্য দেখা যায়। লেম্যান টার্মে আছে উগ্র নারীবাদ। এই গ্রুপের কথাবার্তা অনুযায়ী, পৃথিবীর সব নারীই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত। সেটা ঠিক মোটাদাগের ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন এসব না, বিভিন্ন সুক্ষ্ম মানসিক ব্যাপার যেটা সাধারণের পক্ষে দুঃখবিলাস ছাড়া কিছু নয়। এর থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে (না, উনারা এমন কিছু বলেন না যদিও) সব পুরুষকে ফরম্যাট মেরে নারীবাদী বানিয়ে ফেলা, অথবা পৃথিবী পুরুষ শূন্য করে দেওয়া, সঙ্গে এসব বুঝে না এই টাইপ মেয়েদেরও নাই করে দিলে ভাল হয়। উনাদের দেখলে সাধারণে আঁতকে ওঠে, কথা শুনলে কানে হাত দেয়। এনারা তোমাকে ঘর সংসার, রান্নাবান্না, বাচ্চাকাচ্চা পালা এ সবকিছুই করতে দেবেন না, ওসব পুরুষতান্ত্রিক মহিলাদের কাজ। তাদের কথা এ কারণে কেউ শোনে না। আদর্শ সমাজতন্ত্রের মতো এটাও প্রায় অবাস্তব নারীবাদ। তাদের সমাধান সংক্রান্ত কথা যেমন ওম্যান এমপ্লয়মেন্ট, ফ্যামিলি সাপোর্ট, হেলথ এসব নিয়ে তেমন কথা বলতে শোনা যায় না। ধর্ম ও পুরুষকে গালি দিয়ে নারীবাদের ওয়াজ আর কত? নতুন নতুন শুনতে একরকম ভাল লাগে, কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে তসলিমার কাছে শুনে আসছি। সেই গল্প এখন ঠাকুরমার ঝুলির মতোই পুরনো।
আরেক দল, পুরুষবাদী। তারা নারীদের সহজ বাংলায় শাবানা ফরম্যাটে দেখতে চান। আপনি জোব্বা আচকান পরে সারাক্ষণ শুদ্ধতা বজায় রেখে বেঁচে থাকবেন। প্রেম করবেন না, নিজস্ব বলে কিছু থাকবে না। সংসার সামলাবেন, নো ম্যাটার হোয়াট মাটি কামড়ে স্বামীর বাড়ি পরে থাকবেন। এতকিছুর পর যদি কেউ ধর্ষণ করে, মেরে ফেলে তো কিছু সমবেদনা পাবেন। উনারা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে বিচার-টিচার চাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করতে পারেন। এটাও উগ্রতা। কারণ পৃথিবীটা ফেয়ার প্লেস না। সবাই একই সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জন্মান না, একই পার্টনার পান না। পারিপার্শ্বিকতাও এক থাকে না। রিলেটিভিটির ওয়ার্ল্ডে আপনিও রিলেটিভ অপরচ্যুনিটি নিয়ে রিলেটিভ ক্যাপাসিটি নিয়ে বেঁচে থাকেন। এখানে কোনো ফরম্যাট নেই।
এদের মধ্যে অতি সংখ্যালঘু আছেন, যারা বাস্তবিক সমাধানের কথা ভাবেন। যেমন আপনি পথে-ঘাটে যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন, এখানে সব পুরুষ ধর্ষক বলে গালি দেওয়া অথবা ঢোলা নেকাবওয়ালা বোরখা সমাধান না। আপনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। ধরে মাইর দেওয়ার মানসিকতা বা পুলিশ কমপ্লেইন করতে হবে। দেশে কার্যকরি আইন থাকতে হবে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদ-, অথচ তা প্রমাণ করার উপায় নেই, থাকলেও কেস চলে ১০ বছরÑ এভাবে অত্যাচার কমবে না। সকল ফেসবুকার একমত হলেও না। প্রতিবাদের ইভেন্টে ১ লাখ গোয়িং হলেও না।
আপনি ঘর সংসার করতে চান, আপনাকে সঠিক লোক বিয়ে করতে হবে, যদি পার্টনার ঠিকঠাক না হয়, এর ব্যবস্থা নিয়ে বের হয়ে আসতে হবে। নিজে কাজকর্ম করতে হবে। আপনাকে কেউ শাড়ি পরে চেয়ারে বসে থাকলে ২০ হাজার টাকা বেতন দেবে না। ইউ মাস্ট হ্যাভ স্কিল। স্কিল এচিভ করতে হবে।
আপনাকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। জিরো সাইজ কোকের বোতল বা নমনীয় কোমনীয় লবঙ্গলতিকা না, হাট্টাকাট্টা শক্ত হাড়মাংসের অধিকারিণী, যা দিয়ে আপনি শক্ত হয়ে দাঁড়াবেন। কাজকর্ম করবেন, আত্মনির্ভরশীল হবেন। নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন। দীর্ঘজীবন পেলে অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে না। এই সংখ্যালঘুদের কথা কারও পছন্দ হয় না। প্রথমোক্ত দল দুঃখবিলাসী কথাবার্তা বলতে থাকেন। দ্বিতীয় দল তাদের গাল পাড়তে থাকেন। সাধারণ সংখ্যাগুরু মহিলারা বোরখা আচকান পরে ভয়ে ভয়ে জীবন পার করেন। পিতা,স্বামী, সন্তানদের মন জুগিয়ে চলেন। তাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই। প্রথম দল বলবেন, তুই দাসী, দ্বিতীয় দল বলবেন এই জীবনই মেয়েদের হবার কথা। ৫-১০ লাখ মোহরানায় সে বিক্রি হয়ে গেছে, সোল্ড আইটেম ক্যান নট বি রিটার্নড। একজন মেয়ে আসলে কি চায়, কেউ জিজ্ঞেস করেছেন? (এটাও ভুল জিজ্ঞাসা, চাওয়া তার বয়স, পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতা ভেদে একেকরকম হবে) মোটা দাগে, সে নিরাপত্তা চায়, স্বাধীনতা চায়, নিজের মতো বাঁচতে চায়। পরিবার, সংসার, সন্তান, সচ্ছলতা নিয়ে বাঁচতে চায়। নারীবাদীরা যে চাহিদার কথা কোনোদিন স্বীকার করে না, মেয়েরা একজন সংবেদনশীল স্বামী, সঙ্গীও চায়। তাদেরও জৈবিক চাহিদাও আছে।
এখন শুধু চাইলেই যে দিতে বাধ্য থাকিবে, এমন কোনো অবস্থা নেই। সুবিধা সকলেই চায়, এই যেমন পুরুষতান্ত্রিকতা চাইছে পৃথিবীর সকল রমণী রূপে লক্ষ্মী, গুণে স্বরসতী হয়ে তাদের অনুগত হয়ে থাকুক। তাদের সকালে গরম নাস্তা, দুপুর রাতে সপ্তব্যঞ্জন সহকারে গরম ভাত, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, পরিপাটি ঘর বিছানা, পরার জন্য পরিষ্কার, ইস্ত্রি করা কাপড় থাকুক, তাদের বাপ-মা, ভাই-বোনাই এরও যাবতীয় ফরমাস হাসিমুখে করে দিক। এমনকি অন্যায় আবদার বলুন, তারা তো তাদের পরিশ্রমের টাকা সংসারেই দিচ্ছেন।উনারা চাইলেই আমরা রাজি হয়ে যাচ্ছি না, সারাজীবন ভর আপনাদের ধোপা, বাবুর্চি, বুয়া হতে আমাদের বয়েই গেছে। নিজের রাস্তা দেখেন ভাই। রান্না শিখেন, বাচ্চার দুধ বানাতে শেখেন, নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখেন, আমাদের রেহাই দেন। সেই সময়ে আমি ফুচকা খাই কি, সিরিয়াল দেখি তার হিসাব চাইবেন না। আমাদেরও রিক্রিয়েশন দরকার আছে। আমাদের গৃহকর্মীরাও এখন আর বাড়ির কাজ করেন না, সুতরাং বুঝতেই পারছেন। ঘর বাহির এখন দুজনকেই সামলাতে হবে।
সারমর্ম হচ্ছেÑ আপনি যা চান, তা আপনাকে অর্জন করতে হবে। অবাস্তব আশা না করাই ভাল, আপনি কালোকুচ্ছিত, গরিব ঘরের মেয়ে, আপনার জন্য ডিজনি প্রিন্স ঘোড়া ছুটিয়ে আসবে না। আপনার মতোই গরিব, টাক মাথা, ভুড়িওয়ালা বেটে ছেলেকে আপনার বিয়ে করতে হবে। না হলে এই আইবুড়ো থাকেন, এ সমাজ কেন কালো মেয়ে হেয় করে, সেই আলাপ বাদ দেন। আপনিও ওই বেটে, কুতকুতে চেহারার লোকটা রিজেক্ট করেছেন। সবার রুচিই আপনার রুচির মতোই উন্নত। বাস্তববাদী হন। সমাজকে গালি দিলে সমাজ রাতারাতি পালটে যায় না, এর জন্য কাজ করতে হয়। অল্পবয়সে ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে ফেসবুক সেলিব্রেটির সঙ্গে ভেগে গেলে আপনার দায়িত্ব কেউ নেবে না। লাইভ ফেসবুকে সুইসাইড করলে সমাজ পালটায় না। আপনিই সমাজ। আপনি আপনার সংজ্ঞা মতো আদর্শ মানুষ হন, সমাজ পালটে যাবে অনেকটা।
নারীবাদ নিয়ে যারা কথা বলেন, এমনকি যারা এর সমালোচনাও করেন, আমার বিশ্বাস তারা অধিকাংশই মেয়েদের ভাল চান। তারা চান, মেয়েরা ভাল থাকুক, তাদের উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া না হোক। তবে সেই ভাল চাওয়া নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মতো একপেশে বলে, ভাল চাওয়ার কথাটা পারস্পরিক ঝগড়া আর ভুল বোঝাবুঝিতে আটকে যায়। নারীর ভাল থাকা নিয়ে যে নারীবাদ, তা কারোর উপকার করতে না পেরে সাধারণ মানুষের চক্ষুশুল হয়।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সিডনী প্রবাসী
সম্পাদনা: আশিক রহমান